১. ভারতে হিন্দি সিনেমার ধারাই পাল্টে দিয়েছিল বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। ১৯৫২ সালে মুম্বাইয়ে (তখন নাম ছিল বোম্বে) অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিমল রায় দেখেছিলেন ভিত্তোরিও দে সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’। সিনেমা দেখেই ফেরার পথে সিদ্ধান্ত নেন যেখানের ঘটনা, ঠিক সেই স্থানেই শুটিং করে বাস্তবসম্মত একটি সিনেমা বানাবেন। সেই সিনেমাটিই ‘দো বিঘা জমিন’। ছিলেন বলরাজ সাহানি ও নিরুপমা রায়। ইতালির নিও-রিয়েলিস্টিক সিনেমার যে হাওয়া, তা ‘দো বিঘা জমিন’ দিয়েই ভারতে নিয়ে এসেছিলেন বিমল রায়। এখনো ভারতের সিনেমা ইতিহাসে একটা বড় জায়গা দখল করে আছে ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি।
২. বাঙালি অবশ্য ‘দো বিঘা জমিন’ বলতে ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটির কথাই মনে করেন। বিমল রায়ও বাঙালি ছিলেন। তিনি ‘দো বিঘা জমিন’ সিনেমাটি বানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই। কবিতাটি লেখার তারিখ ছিল ১৩০২ সালের ৩১ জ্যৈষ্ঠ। অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় ১৮৯৫ সালের ১৪ মে। সুতরাং ৫৮ বছর পরে কবিতা থেকে গল্পটা ধার করে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন বিমল রায়।
গল্পটা ছিল এ রকম: শম্ভু মাহাতো স্ত্রী পার্বতী, এক পুত্র ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে গ্রামে থাকেন। দরিদ্র শম্ভুর সম্পত্তি বলতে কেবল আছে দুই বিঘা জমি। আর গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি ঠাকুর হরনাম সিং। দুর্ভিক্ষ আর খরা তাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে ঠাকুরের কাছ থেকে ধার করতে হয়। সেই ঠাকুর গ্রামে একটা কারখানা করবেন। সমস্যা হচ্ছে কারখানার জন্য নির্ধারিত জায়গার ঠিক মাঝখানেই আছে শম্ভুর সেই দুই বিঘা জমি। সুতরাং এটা চাই। সেই জমি শেষ পর্যন্ত কীভাবে ঠাকুরের দখলে গেল, সিনেমার কাহিনি তা নিয়েই।এবার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার প্রথম অংশটুকু পড়লেও পুরো গল্পটা অনুমান করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই—
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা—
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’
৩. রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বাগানবাড়ির জন্যই জমি দখলের কথা লিখেছিলেন। বিমল রায় অবশ্য কিছুটা সদয়। তাই কারখানা নির্মাণকে গল্পে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার দখলদারেরা অতটা সদয় নন। তাঁদের জমি চাই বাগানবাড়ির জন্যই।উদাহরণ হচ্ছে আজকের প্রকাশিত একটি সংবাদ। শিরোনাম হচ্ছে, ‘সিকদারদের বাগানবাড়ির জন্য ভিটেছাড়া তাঁরা।’ সংবাদটিতে বলা হয়েছে, ‘সুমিত্রা রানী দের বয়স ৬৫। রোগশোকে জীর্ণ সুমিত্রাকে এ বয়সে বসতভিটা ছাড়তে হয়েছে। ভাইয়ের তিন এতিম মেয়েকে নিয়ে চার বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের পরিত্যক্ত রান্নাঘরে। প্রভাবশালী সিকদার পরিবারের শখের বাগানবাড়ি করতে তাঁদের ভিটেছাড়া করা হয়েছে বলে অভিযোগ সুমিত্রা রানী পরিবারের। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারদের এ বাগানবাড়ির অবস্থান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক এলাকায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর গ্রামে। তিনি সেখানে জেড এইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় ও মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। এর আধা কিলোমিটার দূরত্বে নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক ও ভেদরগঞ্জের কার্তিকপুর গ্রামে অন্তত ৩০ একর জমির ওপর ২০০৯ সালে বাগানবাড়ি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে সিকদার পরিবার।স্থানীয় লোকজন বলেছেন, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনে তা সীমানাপ্রাচীর দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর ভেতরে বাগানবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে থাকেন। দুটি পুকুর, পুকুরের মধ্যে চারতলা দৃষ্টিনন্দন ভবন, ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড, হরিণের খামার, দুটি পুকুরের সংযোগস্থলে সেতু ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা লাগানো হয়। এর মধ্যেই সুমিত্রা রানীর পৈতৃক ৪১ শতক জমি রয়েছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই জমির একাংশে মাল্টা ফলের বাগান, পাম্প হাউস, ভবনে প্রবেশের সেতু ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আর বাড়ির কিছু অংশ দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে সুমিত্রাদের একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর এখনো রয়েছে।’
৪. ঠিক যেন সেই ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় লেখা সেই ঘটনা। আর ঠিক এ কথাটাই বললেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত নিউজটি শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ‘‘দুই বিঘা জমি’’ কবিতার সঙ্গে কি অদ্ভুত মিল। শুধু প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে; সামন্ততন্ত্রের জমিদারদের জায়গায় নিয়ন্ত্রণ ও নীতিহীন পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশ। অভিযোগটির সুষ্ঠু তদন্ত হোক। সরকারের গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার (সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে) ঘোষিত নীতিটি সঠিক; কিন্তু অজপাড়াগাঁয়ে হঠাৎ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আধুনিক প্রাসাদসম বিলাসবহুল অট্টালিকাগুলো সেই ধরনের গ্রামীণ রূপান্তরের লক্ষণ নয়।’
৫. অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন। সুমিত্রা রানীও ভিটেমাটি ফিরে পাওয়ার আকুল আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রভাবশালী সিকদার পরিবারের ভয়ে কেউ কিছু করতে পারছেন না। তারা কতটা প্রভাবশালী তা বোঝার জন্য গত এক বছরে পরিবারটির কর্মকাণ্ডে নজর দিলেই যথেষ্ট। তখন পাঠককে কেবল ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি পড়লেই হবে না। বরং মার্লোন ব্রান্ডো অভিনীত ‘গডফাদার’, রবার্ট ডি নিরোর ‘গুডফেলাস’ বা ‘আইরিশম্যান’–এর মতো সিনেমা দেখলে কিছুটা ধারণা পাওয়া হয়তো যাবে।
যেমন কথায় কথায় গুলি করা। গত ২০২০ সালের ৭ মের ঘটনা। বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়াকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ভাই দিপু হক সিকদার। এ নিয়ে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। এর আগে ঘটনাটি নিয়ে হয় অনেক ধরনের নাটক।
সিকদার গ্রুপের হাতে এখন বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বলা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংককে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত রেখেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির একের পর এক অনিয়ম, তা নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন, জরিমানা ও শাস্তির সব কাহিনি লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। সবশেষ ঘটনা হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সিকদার পরিবারের অর্থ পাচার। সুতরাং জমি দখল, আরেক ব্যাংকের এমডিকে গুলি, ব্যাংকের অর্থ নয়ছয়—সব মিলিয়ে সিকদারদের কর্মকাণ্ড বহুবিধ। তারপরও তাঁরা বহাল তবিয়তেই আছেন। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা প্রবল প্রভাবশালী।
সুতরাং অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন, তা ফেসবুকের স্ট্যাটাসেই থেকে যাবে। হয়তো একদিন উপেনের মতো সুমিত্রা রানীকে একদিন বাবুর সামনে হাজির করা হবে। আর বাবু ছিপ হাতে পারিষদসহ মাছ ধরতে ধরতে ক্রোধে বলে উঠবেন ‘মারিয়া করিব খুন।’