সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রথমবারের মতো আইন অনুযায়ী গঠিত হলো নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য চার কমিশনার হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান।
গতকাল শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তাদের নিয়োগসংক্রাপ্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন ইসি গঠনে সার্চ কমিটির দেওয়া নামের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ দেন। এরপর গতকাল বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত আলাদা দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে দেওয়া ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ দিয়েছেন বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
আজ রবিবার নতুন ইসির শপথ অনুষ্ঠান হবে।সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে বিকেল সাড়ে ৪টায় হবে শপথ অনুষ্ঠান। সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি তাদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন।
নিয়োগ পাওয়ার পর সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিইসি হিসেবে নিজের দায়িত্ব স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে পালন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেষ্টা করব।’
সিইসি হিসেবে চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। আমরা চাই সবাই আমাদের সহযোগিতা করবে। আর সবার সহযোগিতা পেলে কিছুটা হলেও সফলতা আসবে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের লক্ষ্যে ১০ জনের নাম সুপারিশের জন্য গত ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে এর প্রধান করা হয়। যোগ্য ব্যক্তিদের নাম বাছাই করতে গত ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনটি বৈঠক করে সার্চ কমিটি। এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া বিশিষ্টজনরা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ্য ব্যক্তিদের কিছু নাম প্রস্তাব করেন। সার্চ কমিটির কাছে ৩২২ জনের নাম জমা পড়ে। এরপর তারা কয়েকটি বৈঠক করে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ১০ জনের এ তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেন সার্চ কমিটির সদস্যরা। সেখান থেকে ৫ জনকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেন রাষ্ট্রপতি।
‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পেশ করতে কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেয়।
এক নজরে
সিইসি আউয়াল : কাজী হাবিবুল আউয়ালের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। তিনি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন বাবার চাকরির সুবাদে। হাবিবুল আউয়ালের বাবা কাজী আবদুল আউয়াল কারা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বাদী ছিলেন তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) আবদুল আউয়াল।
হাবিবুল আউয়াল ১৯৭২ সালে খুলনার সেন্ট জোসেফ’স হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
বিসিএস ১৯৮১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা মুন্সেফ (সহকারী জজ) হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেন। নানা পদ পেরিয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর নেওয়ার পর এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। ৬৬ বছর বয়সী হাবিবুল আউয়াল পাঁচ বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। এরপর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছিলেন।
মুন্সেফ থেকে ১৯৯৭ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হন হাবিবুল আউয়াল। ২০০৪ সালে হন অতিরিক্ত সচিব। ২০০৭ সালে পদোন্নতি পেয়ে একই মন্ত্রণালয়ের সচিব হন তিনি। সচিব হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়েই ছিলেন হাবিবুল আউয়াল।
২০১০ সালে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে হাবিবুল আউয়ালের নিয়োগের সময় নীতিমালা মানা না হওয়ায় আদালত তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। আইন সচিব থাকা অবস্থায় বিধিবহির্ভূতভাবে দুই বিচারককে অবসরে পাঠানো নিয়েও জটিলতায় জড়িয়েছিলেন তিনি। সংসদীয় কমিটি এজন্য তাকে তলব করলে তিনি ওই ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ক্ষমাও চান। এরপর ২০১০ সালের এপ্রিলে তিনি ধর্ম সচিব হন। পরে তাকে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব করা হয়। ২০১৪ সালে সেখান থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব করে পাঠানো হয় তাকে। ওই বছরই পদোন্নতি পেয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব হন তিনি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল হাবিবুল আউয়ালের। কিন্তু পিআরএল বাতিল করে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১৬ সালে আরও এক বছর বাড়ানো হয় চুক্তির মেয়াদ। এরপর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেই জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসরে যান তিনি। তিন মেয়ের জনক হাবিবুল আউয়ালের স্ত্রীর নাম সাহানা আক্তার খানম।
নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা এমিলি : নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বেগম রাশিদা সুলতানা এমিলি সিরাজগঞ্জের সন্তান। তিনি সবশেষ রংপুরে জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে গাইবান্ধায়ও জেলা জজের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৫ ব্যাচের জুডিশিয়াল সার্ভিসের এ কর্মকর্তা ২০২০ সালে অবসরে যান।
নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান : সবশেষ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন আহসান হাবীব খান। এর আগে তিনি প্রেষণে বিটিআরসির মহাপরিচালক (ডিজি) ছিলেন। তিন বছর বিটিআরসির স্পেকট্রামের ডিজি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বিটিআরসিতে একটি প্রকল্পে এক বছরের জন্য ডিজির দায়িত্ব পালন করেন এই সেনা কর্মকর্তা। ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান আহসান।
সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই : নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নিয়োগ পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় মো. আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাই সবাইকে নিয়ে কাজ করতে। নিয়োগ পাওয়ার পর সাংবাদিকের টেলিফোনে জানতে পেরেছি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। এখন আর বেশি কিছু বলতে পারব না। শপথ নিই, অফিসে যাই, তারপর বলব।’
২০২১ সালে নির্বাচন কমিশনের সচিব থাকা অবস্থায় অবসরে যান মো. আলমগীর। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসিতে সিইসি ও সচিবের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধের মধ্যে আলোচিত ছিলেন তিনি। মাহবুব তালুকদারসহ চার নির্বাচন কমিশনার একাট্টা হয়ে এ সচিবের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনে সচিব পদে যোগ দেওয়ার পর তাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বিএনপি।
এর আগে তিনি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ছিলেন। মানিকগঞ্জের সন্তান আলমগীর প্রশাসন ক্যাডারে ৮৬ ব্যাচের কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।
আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করব : নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করব। শপথ নেওয়ার সব সবাই মিলে বসেই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে, অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা করব।
এর আগে আনিছুর রহমান জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিব হিসেবে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে যোগদান করেছিলেন। এরপর ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি পিআরএলে (এক বছরের অবসরোত্তর ছুটি) যান।
আনিছুর রহমান ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৯৮৫ ব্যাচের সদস্য আনিছুর রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিজীবনে তিনি সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করে মাঠ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কর্ম-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব এবং ওই মন্ত্রণালয়ে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল থেকে সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আনিছুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ হতে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।