সহশিক্ষার ধারণা ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃতি-বহির্ভূত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষাপন্থায় সহশিক্ষা ছিল না। তিনি নারী সাহাবিদের শিক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন স্থির করেছিলেন। এ ছাড়া উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. পর্দার আড়াল থেকে পুরুষ শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। ইসলামি ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত নারী-পুরুষের পৃথকীকরণ ছিল।
পশ্চিমা চিন্তাদর্শন ও শিক্ষাব্যবস্থার উপজাত এই সহশিক্ষা। এ শিক্ষাব্যবস্থার উৎপত্তি হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্কটল্যান্ডে; আর তা বাস্তবায়ন করে কিছু প্রাইভেট ও সরকারি স্কুল। পরবর্তীকালে এ পদ্ধতি গ্রহণ করে আমেরিকার কয়েকটি স্কুল-কলেজ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে নারীবাদী আন্দোলনের অনুসারীরা সহশিক্ষার একটি ধারা প্রচলনে জোর প্রচারণা চালাতে শুরু করে, যেখানে নারীরা কেবল পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্লাসই করবে না, স্কুলেও তাদের পাশে বসবে। কিন্তু সহশিক্ষা নিয়ে গত ৩০ বছরের ইতিহাসে নানা সমস্যা দেখা গেছে। ফলে পশ্চিমা কিছু বুদ্ধিজীবী নারী-পুরুষের আলাদা শিক্ষাব্যবস্থাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন।
মানসিক গঠনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্যকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়। কুরআনেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে নারী-পুরুষ সমান নয়। আল্লাহ বলেন,
﴿وَ لَیۡسَ الذَّکَرُ کَالۡاُنۡثٰی﴾
আর পুত্রসন্তান কন্যাসন্তানের মতো নয়। [সুরা আলে ইমরান : ৩৬]
এখানে যে পার্থক্যের কথা উল্লেখ হয়েছে তা বিস্তৃত। মূলত এখানে উভয় লিঙ্গের জৈবিক, মানসিক ও আবেগিক পার্থক্য বোঝানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে নারী-পুরুষের জৈবিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। ফলে তাদের মধ্যে গঠন ও শিখনমূলক নানা প্রকার আচরণে পার্থক্য দেখা যায়। কৈশোরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দ্রুত বিকাশ ঘটে। মানসিক প্রবণতার ওপর জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া আছে। নারী-পুরুষের অন্তর্জাত জৈবিক পার্থক্যের কারণে তাদের মানসিক স্বভাব-প্রকৃতিতেও ব্যাপক পার্থক্য লক্ষণীয়।
এ লেখায় সহশিক্ষার নেতিবাচক এবং আলাদা শিক্ষার (একলৈঙ্গিক) ইতিবাচক দিক ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হবে।
সহশিক্ষার মানসিক ক্ষতি
ছেলে ও মেয়েকে একই শ্রেণিকক্ষে বসানো তাদের উভয়ের জন্য অস্বাস্থ্যকর ও ক্ষতিকর হতে পারে। বিখ্যাত আলিম ও ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম ইবনু হাজম রাহ. লেখেন, ‘আমি তোমাদের কাছে একটি কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, যখন কোনো পুরুষ অনুভব করে কোনো গায়রে মাহরাম নারী তাকে দেখছে বা শুনছে, তখন সে এমন কথা বলে বা কাজ করে, যা অস্বাভাবিক ও অদ্ভুতুড়ে; ফলে সে নানা বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে বা অঙ্গভঙ্গি করে। একইভাবে নারীরাও এমন কাজ করে বা কথা বলে, যখন তারা বোঝে কোনো গায়রে মাহরাম তাকে দেখছে।’
কথাগুলো সাধারণ মনে হলেও ইবনু হাজমের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নগুলো আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা সমর্থিত। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
জর্জ গিলডার তাঁর মেন অ্যান্ড ম্যারেজ (Men and Marriage) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সহশিক্ষামূলক পরিবেশে ছেলে-মেয়ের বয়ঃসন্ধিকাল তুলনামূলকভাবে আগে হয়, এ সময়ে কিশোরদের স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ২০ গুণ বেশি টেস্টোস্টেরন তৈরি হয়। এ কারণে তারা মারাত্মক মানসিক সমস্যা ও যৌনতাড়নায় ভোগে।
একইভাবে কিশোরীদের মধ্যে নারী-হরমোন এস্ট্রোজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা তাদের দুর্বলতা, অলসতা ও বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়। বয়ঃসন্ধিকালে যৌন-হরমোনগুলোর অতিরিক্ত নিঃসরণের কারণে ব্রেইনের একটি অংশে লিম্বিক সিস্টেম উদ্দীপ্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী বিপরীত লিঙ্গকে নিয়ে সবসময় ভাবনায় ডুবে থাকে।
এ প্রসঙ্গে গিলডার উল্লেখ করেন, ‘প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ছেলে-মেয়েদের একটি বড় অংশ সর্বদা বিপরীত লিঙ্গকে নিয়ে ভাবছে। আপনার এটি বিশ্বাস না হলে আপনি স্বপ্নের জগতে আছেন।’
একইভাবে সাউথপোর্ট স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ড. ব্রুস কুক সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই প্রকাশিত নিবন্ধ The Boys Who Will be Gentlemen-এ লেখেন, ‘সহশিক্ষা স্কুলের মতো একলৈঙ্গিক স্কুলে ছেলেদের সামনে সর্বদা মেয়েরা থাকে না। ফলে তাদের দেখতে কেমন লাগছে এটি নিয়ে তারা উদ্বিগ্নও হয় না। এই যেমন, “মেয়েরা কি আমাকে দেখে পছন্দ করবে?”’
উল্লেখ্য, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ একই থাকে। যেসব শিক্ষাক্ষেত্রে সহশিক্ষা বিদ্যমান, সেখানে প্রেম-ভালোবাসা ও প্রাক-বৈবাহিক প্রেম অহরহ দেখা যায়।
ছেলে ও মেয়ে শেখে ভিন্নভাবে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটির নারী বিজ্ঞানী ড. হ্যারিয়েট হ্যানলান (Dr. Harriet Hanlan) গবেষণার অংশ হিসেবে নারী-পুরুষের মস্তিষ্কের অ্যাক্টিভিটি বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণাটি তিনি ছয় মাস থেকে 16 বছর বয়সি 284 জন ছেলে ও 224 জন মেয়ের ওপর পরিচালনা করেন। এ বিষয়ে গবেষণাটি ছিল বড় পরিসরের ও ঝুঁকিপূর্ণ, ফলে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে এটি করা হয়। এতে দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল নানাভাবে বিকাশ লাভ করে। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মিল তেমন পাওয়া যায় না।
মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলো ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ভিন্ন সময়ে, হারে ও ক্রমানুসারে বিকাশ লাভ করে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাষা ও স্থানের দক্ষতা এবং মোটর সমন্বয়ের সঙ্গে জড়িত ক্ষেত্রগুলো।
এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ডক্টর হ্যানলান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভাষার দক্ষতার সঙ্গে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অংশগুলো ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ছয় বছর এগিয়ে। অন্যদিকে ছেলেদের স্থানিক স্মৃতি মেয়েদের তুলনায় চার বছর এগিয়ে। এ কারণে ছেলে-মেয়েরা ভিন্নভাবে গণিত, ভাষা ও ভূগোল শেখে।
একইভাবে মেয়েদের ছয় মাস পর ছেলেদের হাত ও চোখের মধ্যকার সম্পর্ক দৃঢ়তা লাভ করে। চোখ ও হাতের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে চোখ দিয়ে কিছু দেখার পর হাতকে নির্দেশ দেওয়া। যেমন, বল দেখে হাতে তুলে নেওয়া। ছেলেদের দেরি হওয়ার কারণ তাদের আঙ্গুলের স্নায়ু মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলক দেরিতে বিকশিত হয়। পেন্সিল ধরে রাখা বা হাতের লেখার জন্য হাতের সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে বিষয় হচ্ছে, বিকাশগত পার্থক্যের কারণে শিক্ষক ও পিতা-মাতা অন্যায়ভাবে ছেলেদের একপাশে ঠেলে দেন। তাদের বকাঝকার পাশাপাশি দুর্বল ছাত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। ফলে স্কুলজীবনের শুরু থেকেই তাদের মনে স্কুলের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। The War Against Boys গ্রন্থে আমেরিকান দার্শনিক ক্রিশ্চিনা হফ সমারস (Christina Hoff Sommers) মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গগত পার্থক্য-বিবেচনায় মেয়েদের চেয়ে ছেলেরাই দুর্বল। লেখা ও পড়ার দক্ষতায় সাধারণ মেয়ের তুলনায় সাধারণ ছেলে প্রায় দেড় বছর পিছিয়ে থাকে। স্কুলে যাওয়ার আগ্রহও কম থাকে। কলেজে যাওয়ার প্রবণতা তো আরও কম।’
ফলস্বরূপ এ ধরনের ছেলেরা, যারা অল্প বয়সে শিক্ষার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়, তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়। এটা সাধারণভাবে শিক্ষা সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে স্কুলসম্পর্কে তাদের সারা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি নষ্ট করতে পারে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ এডুকেশনের ডিন প্রফেসর ডেবোরা স্টিপেক (Deborah Stipek) ও তাঁর সহকর্মী ট্রিসিয়া ভ্যালেস্কি (Tricia Valeski) তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, যে ছেলেরা কিন্ডারগার্টেনে ভালো করতে ব্যর্থ হয়, তাদের মধ্যে নিজ যোগ্যতার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা জন্মায় এবং সেই নেতিবাচক মনোভাবগুলো ইতিবাচক করা ভবিষ্যতে আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে শেখার পার্থক্য সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়, যা স্পষ্টত সহশিক্ষার পরিবেশে দৃশ্যমান। এরপরও কীভাবে নারী-পুরুষ একসঙ্গে বসে ক্লাস করতে পারে?
বিগত ৪০ বছরে পরিচালিত নানা গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, শিশুকাল থেকেই মেয়েদের শ্রবণদক্ষতা ছেলেদের তুলনায় চার গুণ ভালো। জেন ক্যাসিডি (Jane Cassidy) ও ক্যারেন ডিটির (Karen Ditty) গবেষণায়ও এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় Journal of Music Therapy–তে। তাঁরা ৩৫০ জন নবজাতক শিশুর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করে দেখতে পান, একই বয়সের ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশুর শ্রবণক্ষমতা প্রখর। ফলে নারী-পুরুষের শ্রবণদক্ষতার ভিন্নতা তাদের শিক্ষাক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ মিশ্র-লিঙ্গের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক মৃদু ও নিচু স্বরে কথা বললে ছেলেরা শিক্ষকের কথা ভালোমতো শুনতে পাবে না, নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি করবে। অপরদিকে শিক্ষক যদি উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেন, যাতে ছেলেরা তাকে শুনতে পায়, তবে সামনের সারিতে বসা মেয়েদের মনে হবে শিক্ষক যেন চিৎকার করছেন। তাদের কানে যন্ত্রণা হবে। কারণ, তারা শব্দের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এভাবে শব্দের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষে ভিন্নতা।
এত এত শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থাকার পরেও একই ক্লাসে বসে কীভাবে নারী-পুরুষ ক্লাস করতে পারে?