সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক হিসেবে অভিহিত করা যায় তাকে। দেশের অর্থনীতির ইতিহাসে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের নাম আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের যবনিকা টেনে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। শুক্রবার রাত ১২টা ৫৬মিনিটে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মুহিতের মৃত্যু হয়।
তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে।
পড়াশোনা ও পেশাগত জীবন
আবুল মাল আব্দুল মুহিতের জন্ম হয় ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান সিলেট শহরের ধোপা দিঘির পাড়ে পৈতৃক বাড়িতে। স্কুল ও কলেজজীবনে তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছিলেন।
তিনি ১৯৪৯ সালে সিলেট গভর্মেন্ট পাইলট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে। সেখানেও তিনি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। চাকরির সময় তিনি অক্সফোর্ড এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন।
যুদ্ধ শুরু হলে মুহিত পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ও তারপরে..
মুহিত ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
এরপর ১৯৮২-৮৩ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এইচএম এরশাদ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
পেশাগত জীবনে তিনি কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে।
১৯৯০’র দশকে শুরুর দিকে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গঠন করলে সেখানে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তবে তখন তাকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি।
রাজনীতিতে আব্দুল মুহিতের সক্রিয় পদচারণা শুরু হয় ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে।
তখন তিনি সিলেট ১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু সে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এম. সাইফুর রহমানের (সাবেক অর্থমন্ত্রী) কাছে পরাজিত হন মুহিত।
মুহিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারো আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট ১ আসন থেকে নির্বাচন করে বিএনপির এম সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তিনি।
নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মুহিতকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তিনি টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে কেমন ছিলেন মুহিত?
বাংলাদেশে গত ৩০ বছর ধরে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং বাজেট পর্যালোচনা নিয়ে কাজ করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মুহিত যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, সে সময়টিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মোটামুটি ভালো ছিল। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে সাথে প্রবৃদ্ধির মাত্রাও মোটামুটি ভালো ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় কৃষি ও শিল্পে বড় ধরনের কোন সংকট লক্ষ্য করা যায়নি বলে উল্লেখ করেন ভট্টাচার্য।
তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও দেশের ভেতরে বৈষম্য বেড়েছে এই সময়ে।
মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় শেয়ার বাজারে ব্যাপক ধস নামে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলার অভিযোগও গুরুতর আকার ধারণ করে।
একটা সময় তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের আর নতুন কোন বেসরকারি ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরেও ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা টেকসই করার জন্য যেসব কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন ছিল সেটি দেখা যায়নি মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময়।
তিনি বলেন, সুষম উন্নয়নের জন্য ওনার আকাঙ্ক্ষার অভাব ছিল এটা আমি বলছি না। কিন্তু সে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ, প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করানো এবং পেশাজীবীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার ছিল – সেটা ওনার ক্ষেত্রে অনেক সময় হয়নি।’
লেখক ও গবেষক হিসেবে মুহিত
আমলা, মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদের বাইরে আবুল মাল আব্দুল মুহিতের আরেকটি জোরালো পরিচয় লেখক ও গবেষক হিসেবে। তার লেখা বিভিন্ন বই অ্যাকাডেমিক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে মুহিতের।
তার পাঁচটি বই প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।
ইউপিএল-এর বর্তমান কর্ণধার মাহরুখ মহিউদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইতিহাসের উপরে মুহিতের গবেষণার আগ্রহ ছিল। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি গবেষণার কাজ করতেন।
মুহিতের কোনো পাণ্ডুলিপি নিয়ে সম্পাদকের কোনো পরামর্শ থাকলে তিনি সেটিকে সাদরে গ্রহণ করতেন।
যখন ওনার কোন বই ইউপিএল থেকে পাবলিশ করা হয়নি তখন তিনি ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগতভাবে নেননি। এরপরে তিনি আবারো ইউপিএল’র সাথে কাজ করেছেন।
যেখানেই সাংস্কৃতিক আয়োজন, সেখানেই মুহিত
সাংস্কৃতিক জগত নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল আবুল মাল আব্দুল মুহিতের। মন্ত্রী থাকার সময় অনেক ব্যস্ততার সময়ও তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে হাজির হতেন।
গানের অনুষ্ঠান, চিত্র প্রদর্শনী এবং নানাবিধ সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুহিত প্রায়শই হাজির হতেন।