রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকার এক বস্তিতে ছোট্ট একটি টিনের ঘুপচিঘরে স্বামী ও তিন মেয়ে নিয়ে থাকেন গৃহকর্মী সোনিয়া আক্তার। তাঁর এক মেয়ে এবার বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বাসায় বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে সোনিয়ার আয় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা। আর তাঁর স্বামী রিকশা চালিয়ে মাসে আয় করেন আট হাজার টাকার মতো।সোনিয়া বলেন, গত জানুয়ারিতে তাঁর ঘরভাড়া ৪০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। আর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় পাঁচজনের খাওয়াদাওয়ার খরচ ১০ হাজার টাকায়ও কুলায় না।
কাজের ফাঁকে গত মঙ্গলবার দুপুরে খাবার খেতে বাসায় ফিরেছিলেন সোনিয়া আক্তার। তখন প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। বললেন, হঠাৎ করে সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। প্রায়ই তাঁকে মানুষজনের কাছ থেকে ধারদেনা করতে হয়। তিনি আরও বলেন, টিসিবির পণ্য কিনতে পারলে কিছুটা সাশ্রয় হয়। কিন্তু সে জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন, তাই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার মতো সময় তাঁর নেই।
এটা গেল একজন দরিদ্র মানুষের কথা। এবার দেখা যাক মধ্যম আয়ের মানুষের সংসার কেমন চলছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এক যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করেন মালিবাগের মাহিন উদ্দিন। তাঁর মাসিক বেতন লাখ টাকার কাছাকাছি। পাঁচ সদস্যের পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আলাপকালে তিনি বলেন, করোনার কারণে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বাসাভাড়া বাড়ানো হয়নি। তবে গত জানুয়ারিতে ভাড়া আড়াই হাজার টাকা বাড়িয়েছেন বাড়ির মালিক। করোনার আগে খাওয়াদাওয়ার পেছনে মাসে খরচ ছিল ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকা। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ থেকে ৩৮ হাজার টাকা।
মাহিন জানান, তাঁর বেতন গত জানুয়ারিতে ৩ হাজার ৭৫০ টাকা বেড়েছে। তাঁর দাবি, বেতন যতটা বেড়েছে, তার তুলনায় খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। তাই মাসে মাসে যে সঞ্চয় করতেন, সেটি বাদ দিতে হয়েছে।নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলছে, সেটি জানতে তিনজন প্রতিবেদক গত মঙ্গলবার রাজধানীর কয়েকটি এলাকার দুজন সরকারি কর্মচারী (১৭তম গ্রেডের), তিনজন বেসরকারি চাকরিজীবী, তিনজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দুজন গৃহকর্মী, দুজন কারখানার শ্রমিক, একজন বাড়ির কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) ও একজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলেন। এই ১৪ জনের মধ্যে আটজনই জানিয়েছেন, এখন তাঁদের মোটামুটি প্রতি মাসেই ধার করে সংসার চালাতে হয়। আর চারজন জানিয়েছেন তাঁরা কিছু সঞ্চয় করেন, তবে তা আগের চেয়ে কম।
সাধারণ মানুষের খরচের বড় চারটি খাতের সব কটিতেই ব্যয় বেড়েছে। খাত চারটি হলো খাদ্য ও ঘরের নানা উপকরণ কেনা, বাসাভাড়া ও সেবার বিল, সন্তানদের পড়াশোনা এবং পরিবহন খরচ। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার আগের মাস অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির চেয়ে গত মাস ফেব্রুয়ারিতে চাল, তেল, ডাল, মুরগি, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম বা এলপি গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৮ থেকে ৮২ শতাংশ পর্যন্ত। ডিজেলের দাম বাড়ায় বাস ও লঞ্চভাড়া একলাফে বেড়েছে ২৭ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পরে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সামনে পবিত্র রমজান মাস। এরই মধ্যে সয়াবিন তেল নিয়ে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন করে সরকার গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলোয় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে ঘরে ঘরে দুশ্চিন্তা।জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ দুঃসময়ে আমার একটাই পরামর্শ, কোনো অবস্থাতেই গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো যাবে না। বাড়ালে সাধারণ মানুষের ওপর ভয়াবহ পরিস্থিতি নেমে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, ভর্তুকি কমাতে হবে। আমি বলব আরেকটা কাজও করতে হবে। সময় অনুপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের যেসব অপচয় হয়, সেগুলো আগে কমাতে হবে।’
দাম কতটা বেড়েছে
টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারির তুলনায় গত ফেব্রুয়ারিতে মোটা চালের দাম ৩২ শতাংশ, সরু চাল ২৮, বোতলজাত সয়াবিন তেল ৫৫, খোলা সয়াবিন তেল ৮২, মোটা দানার মসুর ডাল ৬৩, চিনি ৩২, ব্রয়লার মুরগি ২১, খোলা আটা ২২ ও এলপি গ্যাসের দাম ১৮ শতাংশ করে বেড়েছে।শ্রমজীবী পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে ৪০ কেজি চাল লাগে। টিসিবির মূল্যতালিকা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৪০ কেজি মোটা চাল কিনতে লাগত ১ হাজার ৪৫০ টাকা। আর গত মাসে লেগেছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। তার মানে শুধু চাল কিনতেই খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকার মতো।মধ্যম আয়ের পাঁচজনের একটি পরিবারে মাসে গড়পড়তা পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল লাগে। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এ তেল কিনতে লাগত ৫১২ টাকা। আর সরকার-নির্ধারিত দামে এ তেল কিনতে গত মাসে লেগেছে ৮০০ টাকার বেশি। যদিও বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে তেল পাওয়া দুষ্কর।
চাল, তেলের মতো বাজারে মাছ, মাংস, সবজির দামও বাড়তি। দুই বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ২৫ টাকা বেড়েছে। করোনার আগে প্রতি কেজি মুরগি ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হতো। আর গত মাসে এ দাম ছিল ১৪০-১৫০ টাকা। আর অধিকাংশ সবজি ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষকেরা যে বাঁধাকপি গড়ে প্রতিটি সাড়ে ১৩ টাকা দরে বিক্রি করেন, সেই বাঁধাকপি ঢাকায় এসে খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩৮ টাকায়। শুধু বাঁধাকপি নয়, বেগুন, শিম, ফুলকপি ও কাঁচা মরিচ কৃষক পর্যায়ের দামের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি হয় ঢাকার বাজারে।
দুই বছরে ব্যয় কতটা বাড়ল
আট বছর ধরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের এক বস্তিতে পরিবার নিয়ে থাকেন রায়হান মোল্লা। বয়স ৪৭ বছর। গত মঙ্গলবার তিনি জানান, তাঁর আট সদস্যের পরিবারের জন্য মাসে চাল, তেল, ডাল, পেঁয়াজ, ডিম, আটা, চিনি, মাছ-মাংস ও শাকসবজি কিনতে দুই বছরে খরচ বেড়েছে প্রায় সাত হাজার টাকা।রায়হান মোল্লা ছাড়াও তাঁর পরিবারের আরও তিনজন উপার্জন করেন। সব মিলিয়ে চারজনের আয় ৩৫ হাজার টাকা। তবে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে রায়হান মোল্লার কপালে। তিনি বলেন, এত দিন আয়–ব্যয় ছিল সমান সমান। কোনোমতে চলতেন। এখন যেভাবে প্রতিদিনই দাম বাড়ছে, তাতে মাস চালানো কঠিন। এরই মধ্যে ঋণ করেছেন।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালের অক্টোবরের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় ওই সময় মানুষের আয় কমেছিল ২০ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চে প্রতিটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। ওই বছরের আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমে যায় প্রায় চার হাজার টাকা। জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ তখন কোনো না কোনোভাবে আর্থিক সমস্যায় ছিল।অবশ্য এখন কেউ কেউ বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ার পর সম্প্রতি তাঁদের আয় কিছুটা বেড়েছে। কারও পরিবারে বেকার সদস্য কাজ পেয়েছেন। রিকশাচালকেরা ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কিছুটা হলেও বেতন বাড়িয়েছে। অবশ্য তার তুলনায় দ্রব্যমূল্য বেশি হারে বেড়েছে।
দুই বন্ধু মিলে তেজগাঁওয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁদের একজন সরকারি কর্মচারী। তিনি তাঁর নাম প্রকাশে অপারগতা জানিয়ে বলেন, বেতন পান সাকল্যে ২০ হাজার টাকা। মাসে তাঁর ভাগে বাসা ভাড়া পড়ে সাত হাজার টাকা। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পেছনে মাসে খরচ হয় দুজনের প্রায় সাত হাজার টাকা। তাঁকে দিতে হয় সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো। এর বাইরে গৃহকর্মীর বেতন, বিদ্যুৎ, পানি ও কেব্ল টিভি বিলসহ অন্যান্য খাতে একজনের ভাগে খরচ পড়ে আরও দুই হাজার টাকা।ওই কর্মচারী বলেন, ‘হাতখরচ, পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য খরচ করে মাস শেষে সঞ্চয় করার মতো টাকা থাকে না। বাড়িতে মা-বাবার জন্যও প্রয়োজনীয় টাকা পাঠাতে পারছি না।’
রাজধানীর মহানগর আবাসিক এলাকার একটি বাড়ি দেখাশোনার কাজ করেন (কেয়ারটেকার) মুহাম্মদ নুরুন্নবী। সংসারে তিনি একাই উপার্জনক্ষম। বেতন সাকল্যে ২৫ হাজার টাকা। বাড়ির কেয়ারটেকার হওয়ায় তাঁর বাসাভাড়া লাগে না। তবু সংসার চালাতে নাকাল অবস্থা তাঁর। তিনি যে হিসাব দিলেন, তাতে মাসে বাজার খরচ লাগে ১৫ হাজার টাকা। আর সন্তানের পড়াশোনা বাবদ খরচ তিন হাজার। সন্তানদের স্কুলে পাঠানো আর নিজেদের যাতায়াত বাবদ আরও তিন হাজার। এই ২১ হাজার টাকার বাইরে তাঁর বেতনের অবশিষ্ট চার হাজার টাকা ওষুধ ও হাতখরচ বাবদ ব্যয় হয়। কোন খাতে কত টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে নুরুন্নবী বলেন, দুই বছরের ব্যবধানে গড়পড়তা বাজার খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ কারণে যাঁরা দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে ছিলেন, তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। বর্তমানে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর সমন্বয় করা প্রয়োজন। তা ছাড়া ডলারের বিনিময়মূল্যেও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে তৎপর হতে হবে। আগামী বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে হবে।