পাঁচ বছরের সাদিয়া আক্তারের হঠাৎ জ্বর ওঠে, সঙ্গে পেট সামান্য ফুলে যায়। প্রথম তিন দিন প্যারাসিটামল খাইয়েছেন শিশুটির বাবা সাইদুর রহমান, এরপর চলে অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু এক সপ্তাহে উন্নতি না দেখে মানিকগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সাদিয়া আক্তারকে, শনাক্ত হয় লিভারে টিউমার।
চিকিৎসকেরা শিশুটিকে দ্রুত পাঠিয়ে দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘটনাটি গত বছরের এপ্রিলের। সাইদুর রহমান বলেন, ক্যানসার শনাক্তের পর সাদিয়া আক্তারকে ৭টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। এরপর অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে আরও ৫টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এখনো মাসখানেক পরপর পরীক্ষার জন্য মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে হচ্ছে।
সাদিয়া আক্তারের মতো অনেক শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব শিশুর বেশির ভাগ রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জোহরা জামিলা খান।তবে দেশে হাতে গোনা যে কয়েকটি হাসপাতালে শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসা হচ্ছে, সেগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক। বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাব্যবস্থা থাকলেও, তা ব্যয়বহুল। তাই সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসে সরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবার দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু ক্যানসার দিবস।
দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ৩৩টি। এগুলোর মধ্যে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে ৮টিতে। সেগুলোতে সব মিলিয়ে শিশু ক্যানসার চিকিৎসকের সংখ্যা ৪০ জনের বেশি নয় বলে জানিয়েছেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক মমতাজ বেগম। এর বাইরে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে এই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় দরকার তিনটি সুবিধা—কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও অস্ত্রোপচার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ছাড়া এসব সুবিধা আর কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জোহরা জামিলা খান বলেন, রক্তের ক্যানসার মূলত কেমোথেরাপিতে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু মাংসপেশি, অস্থি বা মস্তিষ্কের ক্যানসার (যা টিউমার হিসেবে পরিচিত) হলে সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির দরকার হয়। তখন তিনটি হাসপাতাল ছাড়া উপায় থাকে না।সম্প্রতি দেশের প্রতিটি বিভাগীয় সরকারি হাসপাতালে ১৮৬ শয্যার একটি করে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসা ইউনিট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেড় বছরের মধ্যে এসব বিভাগ চালু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ রোবেদ আমিন।তবে চিকিৎসক-সংকট কীভাবে মিটবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, ইতিমধ্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বের হচ্ছেন। ইউনিট পুরোপুরি চালু হলে শিশু ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ দেখাবেন তরুণ চিকিৎসকেরা। বিশেষজ্ঞ তৈরিসহ বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক তৈরি হতে ৫ থেকে ৭ বছরের মতো লেগে যাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি শিশুর ক্যানসার শনাক্ত হয়। উন্নত দেশে ক্যানসার শনাক্ত শিশুদের ৮০ শতাংশ বেঁচে যায়। আর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সেটা ২০ শতাংশ, বাংলাদেশও এই দলে।দেশে মোট কত শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। তবে রোগীদের কিছু তথ্য আছে দাতব্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যানসার ইউকের (যুক্তরাজ্য) কাছে। সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর জুয়েল আহমেদ বলেন, ১৫ মাসে (অক্টোবর ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত) ঢাকার পাঁচটি এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩ হাজার ৫৩ জন ক্যানসারে আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মেয়েশিশুই বেশি, ১ হাজার ৮৬৯টি।
ঢাকার সুবিধাও অপর্যাপ্ত
শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসা হয় মূলত কোনো হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে। হেমাটোলজির আওতায় পড়ে রক্তের ক্যানসার আর অনকোলজি বলতে বোঝায় হাড়, পেশি, লিভার, কিডনি, ব্রেন ক্যানসার ইত্যাদি।রাজধানীতে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে।ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গত রোববার গিয়ে দেখা যায়, শিশু ক্যানসার রোগীদের জন্য ওয়ার্ডে শয্যা আছে ১৫টি। শয্যা ভাগাভাগি করে ২৪টি শিশু ভর্তি আছে। এর বাইরে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি শিশু বাসা থেকে এসে বিভাগের ‘ডে কেয়ার’-এ নিয়মিত চিকিৎসা নেয়।
করোনাভাইরাসে পরিস্থিতির আগে উভয় ধরনের রোগীর সংখ্যাই দ্বিগুণ ছিল বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান জোহরা জামিলা খান। তিনি বলেন, বিভাগটিতে পাঁচজন চিকিৎসক দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।মিটফোর্ড হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে রোববার দেখা যায়, শয্যাসংখ্যা ৮। শয্যার বাইরে ডে কেয়ারে প্রতিদিন ৪৫ জনের মতো শিশু নিয়মিত বাসা থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। বিভাগের দুজন চিকিৎসক দিয়ে মূলত চলছে বিভাগটি।জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে শিশুদের জন্য শয্যা রয়েছে ৪০টি। হাসপাতালটির অধ্যাপক মমতাজ বেগম বলেন, বড়দের বিছানায় রোগীদের মাঝেমধ্যে শিশুদের রাখা হয়। আর বাকিদের ভর্তির জন্য কয়েক দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
অন্য বিভাগীয় হাসপাতালে চিকিৎসা কাগজে-কলমে
ঢাকার বাইরে কিছুটা সুবিধা আছে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাকি বিভাগীয় হাসপাতালগুলোর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগ আছে শুধু কাগজে-কলমে।বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন শিশু ক্যানসার চিকিৎসক আছেন। তবে শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে নয়, তিনি কাজ করছেন অন্য বিভাগে।রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন একজন চিকিৎসক—রেজিস্ট্রার নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু শিশু ব্লাড ক্যানসার বিষয়ে পড়াশোনা করলেও, অন্য ক্যানসারের রোগীকেও দেখতে হচ্ছে। আর রোগীর অবস্থা বেশি আশঙ্কাজনক হলে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন বনি ইয়ামিন, ২০২০ সাল থেকে। তিনি মুঠোফোনে বলেন, সংকটাপন্ন রোগী এখানে রাখা হয় না।আর রংপুর ও সিলেটে বিভাগীয় হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসকই নেই বলে জানিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক।