পাঁচটার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য আর অপেক্ষা না করে হাটতে শুরু করেছি,বয়সের ভারে ঘাড় কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। সামনের দৃশ্য কিছু টা ঝাপসা।চশমা টা বদলাতে হবে কিন্তু সময় করে যাওয়া হচ্ছে না. অফিস থেকে বাড়ি,বাড়ি থেকে অফিস করেই ক্লান্ত হয়ে যাই।ওদিকে বকুল আর বেলির একঝাক বায়না। মেয়ে দুটা এতই চঞ্চল হয়েছে।কতদিন পর ঘর আলো করে এসেছে তারা রোজিনা আর আমার কোল জুড়ে। দীর্ঘকাল একা থাকার পরে কন্যা সন্তান আসা একটা আশীর্বাদ।রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফুল কেনায় ভিড় জমেছে, রজনীগন্ধা কিনতে হবে তবে এখান থেকে নয়,দাম বেশি।আরেকটু সামনে যেয়ে কিনবো “মাহীন ফুলের দোকানঘর”থেকে,মাহীন নামের লোকটা দুটাকা হলেও কম রাখেন, বহু দিনের পরিচয় তার সাথে।
এসব ভাবতে ভাবতে সামনে হেটেই চলছেন আজীম সাহেব। বিকেলের হালকা রোদ মিশে যাচ্ছে শীত করতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারী মাস আসলেই অন্যরকম লাগে।মনটা শান্ত থাকতে চায়না। আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে থাকে।কষ্ট বাড়তে থাকে
কলিংবেল এর আওয়াজ শুবে বাবা এসেছে বলে চিৎকার করতে করতে দরজা খোলে বকুল,বেলিও পিছন পিছনে আসে।
বাবা এনেছো?
হ্যা মা এনেছি, একটু পানি দিতে বলবি তোর মাকে?হাপাতে থাকেন আজীম সাহেব,ক্লান্ত শরীর।
এতো করে বলি রিকশা নিয়ে ফিরো, সে কথা শুনেছো কখনো আমার?দু মেয়েকে সামলিয়ে তোমাকে সামলানো আর পারা যাচ্ছে না, পানির গ্লাস হাতে কড়া গলায় রাগ রোজিনার।
বেলি বকুল হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছে এই বুঝি আবার শুরু হবে বাবা মায়ের এক পষলা ঝড়। আজীম সাহেব অবশ্য কিছু বললেন না,পানি খেয়ে সোজা গোসলে চলে গেলেন। হাতের ফুল গুলো নিজের ঘরে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখলেন। অনেক সময় নিয়ে গোসল করলেন। চোখের পানি আর শাওয়ার এর পানি বোঝা যায়। বাইরে রোজিনা এবং মেয়েদের কথার আওয়াজ আসছে কিন্তু তার ভ্রুক্ষেপ নেই। পুরোনো কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,হালকা একটা আওয়াজ শোনা গেল শুধু, শিউলি…
খুব ভোড়ে উঠে পড়েছেন আজীম সাহেব,কাল সারারাত ঘুম হয়নি ভালো। আজে বাজে সব স্বপ্ন দেখেছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন হঠাৎ পিছনে বকুল এর ডাক,বাবা যাবে না এখনি যেতে হবে তো।
হ্যা মা যাবো,বেলি উঠেছে ঘুম থেকে?
হ্যা বাবা,জামাও পড়ে ফেলেছে। চলো তুমি
যাচ্ছি মা, দেখ আজ কেমন হালকা ঠান্ডা পরেছে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা না?
বাবা,তোমার কাছে এই দিন সবসময় আলাদা
আজীম সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন..
আজীম সাহেব দু হাত দুই মেয়ে ধরে হেটে চলছেন,তাদের হাতে অনেক গুলো রজনীগন্ধা।
বাবা শিউলি ফুপি কি আসলেই লাল সু্য্যির মতো ছিলেন দেখতে? বেলিত আচমকা এই প্রশ্ন শুনে একটু চমকে যান আজীম সাহেব।
হ্যা মা,একদল লাল টুকটুকে সুয্যি মামার মতো ছিলেন,বলেই চোখ টা অন্যদিকে সরিয়ে নেন তিনি।
শিউলি আজীম সাহেব একমাত্র বোন ছিলেন,বাবা মা ছিলো না তারা দুভাই বোন তখন ছাত্র যখন ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয়,দারুন ছবি আকতো মেয়েটি,ভাষা আন্দোলন এর কয়েকটি পোস্টার বানিয়েছল নিযে নিজেই।সেদিন ২১ তারিখের মিছিলে আজীম সাহেব ও ছিলেন বোন কে রিকশা করে বাড়ি পাঠিয়েদিয়েছিলেন,বাসায় ফেরার তাড়া ছিলো ঠিকি কিন্তু বাসায় ফেরা হয়ে উঠেনি শিউলির,সালাম বরকত সেদিন প্রান দিল যেমন তেমন আরো নাম না জানা আরো অনেক বর্নমালা প্রান দিয়েছিল।শিউলি তাদের মাঝে একটা রক্তাক্ত বর্ণমালা। হালকা হলুদ সালোয়ার এর মাঝে লালা রক্ত জমে থাকতে দেখেছিলেন আজীম সাহেব সেদিন,কাঁদতে পারেননি! শুধু লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এভাবে কত শত লাল বর্ণমালার হারিয়ে যাওয়ায় আজকের এই লাল সুর্য উঠে।
এসব ভাবতে ভাবতেই শহীদ মিনারে বেদির কাছে চলে আসেন। কত শত মানুষ সবাই। সেই গান বেজে চলছে,একটা আনন্দ আর চাপা কষ্ট এর মিশ্র অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বেদির দিকে তারা। শিউলির পছন্দ ছিল শিউলি ফুল,শরৎকাল ছাড়া তো আর শিউলি ফুটবে না। তবে রজনীগন্ধার সুবাস শিউলির ভালো লাগতো,প্রতিবছর তার সুবাস এ আলোকিত করতে চায় আজীম সাহেব,হাজারো ফুলের সুবাসেও সেন হারাতে চায় না।কান্না চোখে দুই মেয়ে হাত ধরে এগিয়ে যান তিনি। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে ততক্ষনে
বেলি আর বকুল একসাথে চিৎকার করে ওঠে বাবা দেখো দেখো শিউলি ফুপি উঠছে।
আজীম সাহেন আকাশে রক্তলাল করে ওঠা সুর্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে,চোখ থেকে ঝরে লাল বর্ণমালা…
সাংবাদিক: খাইরুন্নেছা তাকিয়া