“শয়তান যেভাবে ধোঁকা দেয়” বইটি ইবনুল জাওজি রাহ.-এর আরবি বই তালবিসে ইবলিসের অনুবাদ। লেখক ইবনুল জাওজি ছিলেন একজন বড় মাপের আলিম। তিনি আবু বকর রা.-এর বংশধরের, যিনি ছিলেন রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত সাহাবি এবং প্রথম খলিফা। ইমাম ইবনুল জাওজি হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। এই বইটিতে ইসলামের বিভিন্ন ধারা-উপধারা নিয়ে কথা বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তারা কীভাবে শয়তানের প্রতারণার শিকার।
আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু তার পরের প্রজন্মে পৃথিবীতে আসা প্রতিটি মানুষকে শয়তান ধোঁকায় ফেলার চেষ্টা করেছে। “শয়তান যেভাবে ধোঁকা দেয়” বইটি পড়ে জানা যাবে শয়তানের ধোঁকা দেওয়ার প্রকৃতি সম্পর্কে। এতে শয়তানের নানা ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকাও সম্ভবপর হবে।
“শয়তান যেভাবে ধোঁকা দেয়” বইটিতে প্রথমে ভূমিকা এসেছে। এরপর ইবনুল জাওজির ক্ল্যাসিক তালবিসে ইবলিসের চারটি অধ্যায়ের অনুবাদ রয়েছে। কীভাবে কিছু আলিম, সুফি, দার্শনিক ও ভ্রান্ত ইসলামি দলগুলোকে শয়তান তার ধোঁকার চক্রে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেটা নিয়েই আলোচনা হয়েছে এখানে।
এখানে ইসলামের তিনটি বিপথগামী সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে:
খাওয়ারিজ (খারেজী),
শিয়া এবং
বাতিনিয়াহ।
প্রথম দুটি হল মূলধারার ইসলাম থেকে প্রথম বিচ্যুতি, এবং তৃতীয়টি হল শিয়ার একটি শাখা।
জানতে পারবেন ইসলামের বিভিন্ন ধারার ইতিহাস এবং তাদের বিচ্যুতি
“শয়তান যেভাবে ধোঁকা দেয়” বইটি সবচেয়ে উপকারে আসবে তাদের যারা নতুন মুসলিম, যারা ইসলামের বিভিন্ন দল-উপদল সম্পর্কে ধারণা রাখে না বা জানার পর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আপনি নিশ্চয়ই একটা হাদিস শুনেছেন যে রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বনি ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার উম্মত ৭৩ দল-উপদলে বিভক্ত হতে হবে। এর মধ্যে একটি দল ছাড়া বাকিগুলো জাহান্নামে যাবে।”
বলা হল, “কে বেঁচে থাকবে?”
তিনি জবাব দিলেন, “আমি আর আমার সাহাবিরা যার ওপর আছে।” এই বইটি পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে দীনের পথে অটল থাকতে।
শয়তানের উত্থান
সমাজের সমস্যা সমাধান এবং কার্যকর সমাধান প্রদানের জন্য নবীগণ সুস্পষ্ট বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। যাইহোক, শয়তান বিভ্রান্তির পথ প্রবর্তন করেছিল। ভালোর সাথে ক্ষতিকারক জিনিস মিশ্রিত করেছিল। এটা মানুষকে বিপথগামী করেছে এবং অসংখ্য বিপথগামী পথ তৈরি করেছে।
সময়ের সাথে সাথে, শয়তান মানুষের মনকে চালিত করতে থাকে। ফলে দিন দিন মানুষ ইসলামের পথ, মূলত প্রকৃত ইসলামের পথ থেকে সরে যেতে থাকে এবং জন্ম হয় অনেক বাতিল ফিরকার। নানা রকম বিদআতের পথ খুলে যায়। এমনকি কেউ কেউ কাবাঘরের কাছে মূর্তি পূজা শুরু করে। অথচ কাবা এক আল্লাহর ঘর। আরবরাও ভয়ানক রীতিনীতি পালন করত যেমন শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া এবং এতিমদের তাদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
এই নোংরা প্রথাগুলোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে, আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন শান্তি ও রহমত নিয়ে। তিনি এসব ঘৃণ্য প্রথাগুলোকে বাতিল করেছিলেন এবং মানবতার জন্য কল্যাণকর আইন ও বিধান প্রবর্তন করেছিলেন। তার সাহাবিরা তার নির্দেশনা অনুসরণ করেছিল এবং শয়তানের প্রলোভন থেকে তারা নিরাপদ ছিল।
যাইহোক, সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবিদের উপস্থিতিও ম্লান হয়ে যেতে থাকে তাদের ইনতিকালের পর। ফলে পৃথিবীতে আবার ফিরে আসে বাতিল জিনিস ও বিশ্বাস এবং মতবাদ। স্পষ্ট ও হকের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়। বেশিরভাগ লোক তাদের ধর্মকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। শয়তান এর সুযোগ নিয়েছিল। সে সত্যকে অস্পষ্ট করে, লোকেদেরকে প্রতারিত করে, বিভেদ ঘটায় এবং মিথ্যা ছড়িয়ে দেয়।
লেখক শয়তানের ধূর্ত কৌশল এবং ফাঁদ সম্পর্কে লোকদের সতর্ক করার জন্য তালবিসে ইবলিস গ্রন্থটা রচনা করেছেন। কারণ তার কর্তব্য হচ্ছে ভালো কাজে আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজে নিষেধ করা। সহিহ বুখারিতে হুজাইফা রা.-থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে যেখানে তিনি বলেছেন যে, “মানুষ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে ভালোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত। কিন্তু আমি খারাপের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতাম যেন সেগুলোতে পতিত না হই।” সুতরাং, এই বইটি প্রত্যেক মুসলিমের পড়া উচিত যেন তারা বুঝতে পারেন যে তারা সঠিক ইসলামের পথে আছেন কী না। কারণ অনেক মুসলিম সমাজেও প্রথার নামে নানা ইসলামি অনাচার ঢুকে পড়েছে।
ইবলিসের ফিতনা ও ধোঁকার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি
শায়খ আল্লামা আবুল ফারাজ রহ. বলেন, মনে রাখতে হবে, ইবলিসের কাজ হচ্ছে, মানুষকে বিভিন্নভাবে সন্দেহে পতিত করে পথভ্রষ্ট করা। সর্বপ্রথম সে নিজেই এমন সন্দেহে আটকা পড়েছিল। সিজদার ব্যাপারে
আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সে সন্দেহে পতিত হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। যেমন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অবহিত করেছেন এভাবে, যে, ইবলিস বলল, “আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে ।”
অন্যত্র বর্ণিত আছে, “সে বলল, দেখুন, এ ব্যক্তি, যাকে আপনি আমার উপর সম্মান দিয়েছেন, যদি আপনি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দেন, তবে অতি সামান্য-সংখ্যক ছাড়া তার বংশধরদেরকে অবশ্যই পথভ্রষ্ট করে ছাড়ব।” “আমি তার চেয়ে উত্তম” বলে সে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে সে চিরদিনের জন্য আল্লাহর লানত ও শাস্তি খরিদ করে নেয়।
অতএব শয়তান যখন কোনো মানুষকে প্ররোচনা দেয়, তখন মানুষের উচিত, এই চিরশক্রর ধোকা থেকে দূরে থাকা। কাউকে যদি সে বলে যে, আমি তোমার মঙ্গল কামনা করি। তখন তাকে উত্তর দিতে হবে, “যে তুমি নিজের মঙ্গল বোঝো না সে আবার আমার মঙ্গল নিয়ে কী করবে? এছাড়া আমি আমার চিরশক্রর ওপর কী করে ভরসা রাখতে পারি? তোমার কথায় আমি প্রভাবিত হব না।” এখন শয়তান ধোকা দেবার আর কোনো উপায় না দেখে মানুষের ‘নফসে আম্মারা’ থেকে সাহায্য নেয়। নফসকে উদ্বুদ্ধ করে। কেননা নফস উদ্যোগী হয়ে মানুষকে পাপকাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে তাই এ ক্ষেত্রে বিবেকের সাহায্য নিতে হবে। বিবেক গুনাহের পরিণতি চিন্তা করবে।
বইটির ব্যাপারে কিছু তথ্য
ভাষান্তর : মুফতি আবু সাআদ
পৃষ্ঠা : ৪৮০
দ্বিতীয় মুদ্রণ: নভেম্বর ২০১৯
বইটি সম্পর্কে আরো কিছু কথা
শয়তান আমাদের আদি শত্রু। চির শত্রু। মহা শত্রু। তার এ শত্রুতা মানবজাতির আদি পিতা থেকে নিয়ে সৃষ্টির শেষ মানুষটি পর্যন্ত দীর্ঘ। তার অভনব ধোঁকা আর বিচিত্র কূটচাল জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, শূণ্যে-মহাশূণ্যে- তথা পৃথিবীর সর্বত্র সকলের জন্য বিস্তৃত। তার প্রলোভন ও প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে না আলেম-জাহেল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ- কেউই। সর্বত্র সবার জন্য সে পুতে রেখেছে অকল্পনীয়-অবর্ণনীয় পাপের বীজ। পৃথিবীব্যাপী সে বিছিয়ে রেখেছে অজস্র মোহজাল। পেতে রেখেছে অসংখ্য কুটিল ফাঁদ। সূক্ষ্ম-স্থূল সকল প্রকার ফন্দিতে শয়তান অদ্বিতীয়।
শয়তানকে কুরআন মাজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে। তাতে ইবলিশ শব্দটি ব্যাবহার হয়েছে ১১ বার। শয়তানের এ নামেই আলোচ্য গ্রন্থ “তালবিসে ইবলিস” নামকরণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়ার জন্যে শয়তানকে সুযোগ ও অবকাশ দিয়েছেন বটে; কিন্তু শয়তানের প্রতারণা ও বিভ্রান্তি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মানুষকে শয়তানি প্রতারণার যাবতীয় কূটকৌশল জানিয়ে দিয়েছেন এবং বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন।
শয়তানি প্রতারণার কূটকৌশলসমূহ যেমন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন উপস্থাপনের সাথে সাথে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে নিজের বাণীতেও সেগুলো জানিয়ে দিয়ে গেছেন। আলোচ্য “তালবিসে ইবলিস” গ্রন্থটিতে সে বিষয়গুলো অত্যন্ত নিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আল্লামা শায়খ ইবনুল জাওযী রহ.।