দেশে করোনায় মৃত্যু বেড়েই চলছে। একটানা ১২ দিন ধরে দৈনিক দুইশোর ওপরে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সময় মোট মারা গেছেন ২ হাজার ৮৫৬ জন, যা দৈনিক গড়মৃত্যু ২৩৮ জন। এমনকি এই ১২ দিনেই সর্বোচ্চ মৃত্যুর তিনটি রেকর্ড হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় আগের তিনটি রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ছিল ৯ দিন আগে, গত ২৭ জুলাই। সেদিন মারা গিয়েছিলেন ২৫৮ জন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ২১ হাজার ৯০২।
গত ৭ জুলাই দেশে প্রথম দৈনিক মৃত্যু দুইশোর ওপরে ওঠে। সেদিন মারা যান ২০১ জন। এর আগের ১০ দিন দৈনিক মৃত্যু টানা একশোর ওপরে থাকে এবং ২৭ জুন প্রথম সর্বোচ্চ ১১৯ জনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়। এরপর ৭ জুলাই প্রথম দৈনিক মৃত্যু দুইশোর ওপরে ওঠে। পরে গত জুলাই মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ১১ দিন মৃত্যু একশোর ঘরে ছিল এবং বাকি ২০ দিনই দুইশোর ওপরে ছিল। এরপর এ মাসের শুরু থেকেই দৈনিক দুইশোর বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছেন।
এ পর্যন্ত দেশে করোনায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে, ৯ হাজার ৮৮৭ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৫ শতাংশ এবং ঢাকা জেলায় ৬ হাজার ৬৪২ জন। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে, ৪ হাজার ১৬৭ জন, যা মোট মৃত্যুর ১৯ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম জেলায় ১ হাজার ১৪৬ জন।
মৃত্যুর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে গত পাঁচ দিনেই মোট মৃত্যুর সংখ্যা গত ১৬ মাসের যেকোনো মাসকে ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে মৃত্যুর সর্বোচ্চ মাস এ বছরের জুলাইয়ে মোট মারা গিয়েছিলেন ১০ হাজার ৮৪৬ জন ও দৈনিক গড় মৃত্যু ছিল ১৯৯ জন। মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাস এ বছরের এপ্রিলে মোট মৃত্যু ছিল ৪ হাজার ৯২৮ জন ও দৈনিক গড় মৃত্যু ছিল ৮০ জন করে। এরপর মৃত্যুর তৃতীয় সর্বোচ্চ মাস এ বছরের জুনে মোট মারা যান ৩ হাজার ৭৫৭ জন ও দৈনিক গড় মৃত্যু ছিল ৬৩ জন করে। সেখানে এ মাসের পাঁচ দিনেই মোট মারা গেছেন ১ হাজার ২১৭ জন ও দৈনিক গড়ে মারা যাচ্ছেন ২৪৩ জন করে।
এমনকি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন মৃত্যুর ধরন আরও জটিল হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আগে সাধারণত আক্রান্তের দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগীদের মারা যেতে দেখা গেছে। এখন আক্রান্তের দুই-তিন দিনের মধ্যেই রোগীরা মারা যাচ্ছেন। পাশাপাশি এত দিন বয়স্কদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন সে ব্যবধান কমে আসছে। তরুণদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
সামনের দিনগুলোয় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করেছেন আইইডিসিআরের উপদষ্টো ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঈদের আগে যে ৯ দিন শিথিল ছিল, এর সংক্রমণ বা রোগীর প্রভাব পড়বে এ মাসের প্রথম সপ্তাহের পরে ও মৃত্যুর প্রভাব পড়বে দ্বিতীয় সপ্তাহ পরে। সে হিসেবে এ মাসের মাঝামাঝিতে দেশে করোনা সংক্রমণের আরেকটা ‘পিকের’ আশঙ্কা রয়েছে। তারপর কমতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করবে এখন যে বিধিনিষেধ চলছে, সেটার কার্যকারিতার ওপর। তাহলে আগস্টের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ কমার একটা আশা আছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন মৃত্যুর ধরন বদলেছে। আগে আমরা বলতাম আক্রান্তের দুই-তিন সপ্তাহ পর মৃত্যুর প্রভাব বোঝা যায়। কিন্তু এখন যেসব রোগী দুই-তিন দিন আগে হাসপাতালে আসছেন, তারাও মারা যাচ্ছেন। এর প্রধান কারণ দেরিতে হাসপাতালে আসা। এখনো অনেকে মনে করে যে করোনা হয়নি, প্রতি বছরের মতো এখনকার সর্দি-কাশিও সাধারণ। মানুষের এ ধারণা খুবই ক্ষতিকর।
মৃত্যু বাড়ার কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে আসতে পারছেন না বা আসেন না। শ্বাসকষ্ট শুরু না হলে টেস্ট করান না, হাসপাতালেও আসেন না। যখন আসেন, তখন অবস্থা খুব জটিল হয়ে যায়, কিছু করার থাকে না।
সর্বোচ্চ মৃত্যু ঢাকায়, সর্বনিম্ন ময়মনসিংহ বিভাগে : গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে যে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে পুরুষ ১৪০ ও নারী ১২৪ জন। এ সময় ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৮৭ ও সর্বনিম্ন ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকা মহানগরে ৪৭, ফরিদপুরে ৪, গাজীপুরে ৭, গোপালগঞ্জে ১, কিশোরগঞ্জে ৪, মাদারীপুরে ৩, মানিকগঞ্জে ৪, মুন্সীগঞ্জে ৪, নারায়ণগঞ্জে ৩, নরসিংদীতে ৪, রাজবাড়ীতে ১, শরীয়তপুরে ১ ও টাঙ্গাইলে ৪ জনের মৃত্যু হয়।
ময়মনসিংহ বিভাগের ১০ জনের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৭, নেত্রকোনায় ১, জামালপুরে ১ ও শেরপুরে ১ জন রয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগে মৃত ৫৬ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ১১, কক্সবাজারে ২, রাঙ্গামাটিতে ২, খাগড়াছড়িতে ২, ফেনীতে ৪, নোয়াখালীতে ৭, লক্ষ্মীপুরে ৩, চাঁদপুরে ২, কুমিল্লায় ১৬ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭ জন রয়েছেন।
রাজশাহী বিভাগের ১৯ জনের মধ্যে রাজশাহীতে ১, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১, নাটোরে ৪, নওগাঁয় ১, পাবনায় ২, সিরাজগঞ্জে ৫, বগুড়ায় ৪ ও জয়পুরহাটের ১ জন রয়েছেন।
ঢাকায় মৃত্যু-সংক্রমণ বাড়ছে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কয়েক দিন ধরে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হচ্ছে। গতকালও এখানে সর্বোচ্চ ৮৭ জনের মৃত্যু হয়; যা মোট মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। মৃত ৮৭ জনের মধ্যে ৪৭ জন ঢাকা মহানগরীর। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে মারা যান ৫৬, রাজশাহী বিভাগে ১৯, খুলনায় ৩৫, বরিশাল ১৬, সিলেট বিভাগে ২৩, রংপুর বিভাগে ১৮ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জনের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান লকডাউনের মধ্যে ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন প্রাান্ত থেকে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে লোকজন ঢাকা অভিমুখে ছুটে আসছেন, তাতে রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে।
স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্য : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক স্বাস্থ্য বুলেটিনে গত ২৪ ঘণ্টার করোনাসংক্রান্ত তথ্যে বলা হয়, এদিন সুস্থ হয়েছেন ১৫ হাজার ৭৮৬ জন এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৫২২টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৯৫টি। এখন পর্যন্ত ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থ হয়েছেন ৮৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১৪০ জন পুরুষ ও নারী ১২৪ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ ১৪ হাজার ৬৮৪ ও নারী মৃত্যুবরণ করেছেন ৭ হাজার ২১৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ৩ জন, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ১৫ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ৫০ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৭৪ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৩১ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৫ জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১ এবং ০ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ১ জন মারা গেছে।