রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি অনেকদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে চলেছে অথবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। অথচ ব্যক্তিমালিকানাধীন সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতি বছর ভতুর্কি দিতে হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হলেও সেই নিদেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেয়ে অবৈধভাবে অর্থোপার্জনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এদের অনেকেই দেশের বাইরে মুদ্রা পাচারের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন কিছু দিন আগে বলেছিলেন, কানাডার বেগমপাড়ায় যারা বাড়ি কিনেছেন তাদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন অথবা রয়েছেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন কর্মকর্তা যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে নিজের স্ট্যাটাস বজায় রেখে সংসার চালানোই কঠিন। এই অবস্হায় কী করে তার পক্ষে কানাডার মতো দেশে বাড়ি ক্রয় অথবা নির্মাণ করা সম্ভব? আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা কর্মসংস্হান করেন, তাদের অনেকের মধ্যেই অসত্ভাবে বিত্ত-বৈভব তৈরির একটি প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। তারা সব সময়ই একধরনের আত্ম-অহমিকায় ভোগেন। কারণ তারা জানেন, একবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে প্রবেশ করতে পারলে তিনি নিশ্চিন্েত ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে পারবেন। কোনো ধরনের মারাত্মক দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগের সঙ্গে দুর্ভাগ্য যুক্ত হলে কারো চাকরিচু্যতির আশঙ্কা নেই। তারা এতটাই ক্ষমতাবান এবং ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে পারঙ্গম যে, তাদের কোনো বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার তদন্ত করেন একই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোনো কর্মকর্তা। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা যায় সহজেই। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হলে উলটো অভিযোগকারীকেই হেনস্তা হতে হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চার শ্রেণির কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ করা যায়। একশ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, যারা অত্যন্ত ট্যালেন্ট এবং ঘুষ ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তাদের মনোভাব হলো, চাকরি করি বেতন পাই, কাজ করি ঘুষ খাই। আর একশ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, যারা কাজও করেন না, ঘুষও গ্রহণ করেন না। তারা অবসর পেলেই মসজিদে আলোচনায় রত হন অথবা ঘুমান। অন্য একশ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, যারা নিজেরা ঘুষ গ্রহণ করেন না, কিন্তু অন্যেরা ঘুষ গ্রহণ করলে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যের ঘুষ গ্রহণে সহায়তা করেন। সর্বশেষ একশ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, যারা নিজেরা ঘুষ গ্রহণ করেন না আর অন্যকেও ঘুষ গ্রহণের সুযোগ দেন না। এরা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্হান দেন। এরা খুবই বিপদের মধ্যে থাকেন। এসব কর্মকর্তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। সেখানে মালিক সরাসরি উপস্হিত থাকেন না। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকে নূ্যনতম পর্যায়ে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সরাসরি মালিকের অধীনে। কাজেই ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে সততা এবং স্বচ্ছতা থাকে বেশি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা সব সময়ই প্রস্ত্তত থাকেন, কখন অফিস ছুটি হবে এবং তিনি বাড়ি চলে যাবেন। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা তার হাতে থাকা কাজ শেষ না করে বাড়ি যাবার কথা চিন্তা করতে পারেন না।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্র এবং সরকার নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্িত লক্ষ করা যায়। আমরা প্রায়শই ভুল করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানকে সরকারি সম্পদ বলে অভিহিত করে থাকি। কিন্তু এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায়, চারটি আবশ্যিক উপকরণ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে, (১) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (২) সার্বভৌমত্ব, (৩) জনসংখ্যা এবং (৪) সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ হচ্ছে সরকার। কাজেই রাষ্ট্র এবং সরকারকে গুলিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু বেশির ভাগ মানুষই রাষ্ট্র ও সরকারকে এক করে দেখেন, তাই সমস্যার সৃষ্টি হয়। সরকারের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নেই। সরকার জনগণের অনুমোদনক্রমে রাষ্ট্রের সম্পদ দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে। অর্থাত্ সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক নয় আমানতদার মাত্র। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের অন্যায় কর্মের বিচার সাধারণত হয় না বলেই তাদের মধ্যে একধরনের অহমিকা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস থাকতে নেই। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যে দলই সরকার গঠন করুক, সর্বোচ্চ সততা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের নীতি আদর্শ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণির সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তার উপস্হিতি লক্ষ করা যায়, যারা সব সময়ই সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে এমন একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে না, যেখানে কর্মকর্তাগণ দলীয় রাজনীতিচর্চা করছেন না। ১৯৯০ সাল পর্যন্তও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির চর্চা ছিল না বললেই চলে। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চা হয়। বর্তমানে তা মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যারা দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন, তারা কখনোই প্রকাশ্যে বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেন না। তারা সব সময়ই সরকার দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন। কোনো নতুন সরকার ক্ষমতায় আসীন হলেই একশ্রেণির কর্মকর্তা সরকার সমর্থক হিসেবে নিজেদের উপস্হাপন করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পাশাপাশি দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন এরা কোনো দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য মোটেও কৃতিত্বে দাবিদার নন। কারণ তারা বিরোধীদলের অনুকূলে রাজনীতি চর্চা করেন না। তারা সব সময় সরকারদলীয় রাজনীতি করে থাকেন। তাদের কারণে সরকারের কোনো উপকার সাধিত হয় না। বরং তাদের অপকর্মের কারণে একটি জনপ্রিয় সরকারের দুর্নাম হতে পারে। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত কম্বাইন্ড বার্গেনিং এজেন্ট (সিবিএ) এবং অফিসার সমিতি ছাড়া আর কোনো সংগঠন থাকার কথা নয়। সিবিএ কর্মচারী ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার কথা কতৃর্পক্ষের কাছে তুলে ধরে তা সমাধানের চেষ্টা করবেন। আর অফিসার সমিতি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার কথা কতৃর্পক্ষের গোচরে আনবেন। তারা অনুরোধ করতে পারেন, কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য তারা ধর্মঘট বা এ ধরনের কোনো অ্যাকশনেও যেতে পারেন না। কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পরিষদের নামে দলীয় রাজনীতি চর্চা করতে দেখা যায় একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতিচর্চা করছেন তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দলীয় রাজনীতিচর্চা। কিছু কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা অতীত অপকর্ম থেকে রক্ষা পাওয়া অথবা নতুন করে অন্যায় কর্মসাধনের জন্য দলীয় রাজনীতি চর্চা করে থাকেন। একজন মানুষকে তার কর্মজীবন শুরু করার সময়ই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি কী হতে চান। রাজনীতি চর্চা করবেন, নাকি ব্যবসায়ী হবেন নাতি চাকরিজীবী হবেন, এটা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন ব্যক্তির কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ প্রতিষ্ঠান তার অবসরকালীন সময়ের জন্য পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করে। যারা রাজনীতে যুক্ত হতে চান তারা যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরি ত্যাগ করেই তা করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির জন্য অনেকটাই দায়ী হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কার্যক্রমে সর্বোচ্চ দক্ষতা এবং সততা নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতি অনেকাংশেই কমে আসবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্তির কারণে সত্ এবং দক্ষ কর্মকর্তারা প্রায়শই এদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়ে থাকেন। দলীয় রাজনীতির আধিপত্যের কারণে সৎ, দক্ষ কিন্তু নিরীহ কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। এই অবস্হা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার সব রাস্তা বন্ধ করতে হবে। এটা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার,
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড