আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে, কোন খাবার গরমে খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে দিতে হবে অথবা কোন খাবার একেবারেই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। মানুষের অসচেতনতার কারণে খাদ্য সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি রোগ হয়। যেমন- ১. শরীরের অতিরিক্ত ওজন, ২. ডায়াবেটিস, ৩. ইনসুলিন রেসিসটেন্স, ৪. উচ্চ রক্তচাপ, ৫. হৃদরোগ।
কোনো ব্যক্তি যদি উপরোক্ত যে কোনো ১টি বা সবগুলোতে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয় তবে তাদের এই গরমে কিছুটা স্বস্তির জন্য অত্যন্ত সজাগ হতে হবে কেন না প্রচণ্ড গরমে শরীরের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন- ১. দেহে সোডিয়াম কমে যাওয়া, ২. পটাসিয়াম কমে যাওয়া, ৩. বমি হওয়া, ৪. খাদ্য হজম না হওয়া ও পেট ফাপা, ৫. ডায়রিয়া, ৬. আমাশয়, ৭. জ্বর।
গরমে এ শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে প্রতিরোধ করতে খাবারের গুরুত্ব অপরীসিম। গরমে সঠিক পুষ্টির লক্ষ্যে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সে দিকগুলো খেয়াল রাখতে হবে তা হল-
১. প্রথম ও প্রধান সাবধানতা হল বাহিরের খোলা জায়গার পানি, শরবত, আখের রস পরিহার করা, এগুলো গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ডায়রিয়া, আমাশয় হয়।
২. নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি পান করা, ঘরের তৈরি শরবত, পানি জাতীয় শাকসবজি ও ফল বেশি খাওয়া।
৩. গরমে ডাব, তরমুজ, বাঙ্গি, বেলের শরবত এগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে হাত ধুয়ে খাবারের উপযোগী করা।
* গরমে মাছ, মাংস, ভুনা, ভাজি, খিচুড়ি, পোলাও, ফাস্টফুড কমিয়ে পাতলা আম ডাল, পাতলা দুধ, টকদই, করলার ঝোল তরকারি, লেবু চিনির শরবত, সালাদ, রসালো ফল খাওয়া যেতে পারে।
৪.গরমে সাদা ভাত, পোলাও, বিরানি, খিচুড়ি পরোটা থেকে অনেক বেশি খাদ্যোপযোগী।
৫. যারা নিয়মিত হাঁটেন, তারা শুধু সময় পরিবর্তন করলেই চলবে। যেমন সকালে না হেঁটে বিকাল/সন্ধ্যার পর হাঁটা বেশি আরামদায়ক।
৬.গরমে খুব বেশি হাঁটা, ব্যায়াম, অত্যাধিক পরিশ্রম, অত্যাধিক খাদ্য গ্রহণ পরিহার করুন।
৭.পোশাক পরুন আরামদায়ক। হালকা রং বেছে নিন পোশাকে।
৮. নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
গরমে পুষ্টি :
যারা অতিরিক্ত ওজনে ভুগছেন তারা এই গরমে সজাগ হোন পথ্য ও পুষ্টির ব্যাপারে। ওজন কমানোর জন্য গরমকাল সহায়ক। কেননা আপনি যদি উচ্চ ক্যালরি পরিহার করে নিন্ম ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ করেন তবে ওজন কমবে। নিন্ম ক্যালরি খাবারের মধ্যে রয়েছে ফল (যেমন- তরমুজ, বাঙ্গি, জাম, জামরুল, ডাব ইত্যাদি) ও সবজি (যেমন- লাউ, পেঁপে, ঝিংগা, কুমড়া ইত্যাদি)। গরমে খাদ্য তালিকায় তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক হোন। গরমে তেলের ব্যবহার একেবারেই কমিয়ে দিন। কেননা ১ গ্রাম তেল শরীরের ভেতর ৯ কিলো ক্যালোরি তাপ উৎপন্ন করে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও আদ্রতায় শরীরের তাপ বাইরে বেরুতে পারে না।
১ কম তেলে খাবার খেয়ে আপনি স্বস্তি বোধ করবেন, হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমবে
২.আপনার অতিরিক্ত ওজন কমবে
৩.দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলানো যাবে অর্থাৎ তেল কেনার খরচ কমবে।
ইদানীং ‘কোলেস্টেরল ফ্রি’ তেলের প্রচারণা বেড়েছে। এক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব বুদ্ধি যাচাই করুন। উদ্ভিদ উৎস থেকে আসা তেলে প্রাকৃতিগতভাবেই কোনো কোলেস্টেরল থাকে না। এটি তেলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বিশেষভাবে উদ্ভিজ তেলকে কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোলেস্টেরল ফ্রি করা হয়নি। কোলেস্টেরল ফ্রি তেলের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ মনে করে তেল খেলে কোনো ক্ষতি নেই কিন্তু এ কথা পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে। ১ চা চামচ (৫ এম.এল) তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম.এল) ঘি = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা চামচ (৫ এম.এল) সরিষা তেল = ৪৫ ক্যালরি, ১ চা-চামচ (৫ এম.এল) সয়াবিন তেল = ৪৫ ক্যালরি, কোলেস্টেরল ফ্রি হোক বা না হোক ৫ এম.এল তেল বা ঘি-এর ক্যালরি মূল্য কিন্তু একই। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে আপনার শরীরের ওজন বৃদ্ধি পাবে যা আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াবে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি তো রয়েছেই। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি কোনো ভাবেই যে তেলই হোক না কেন তা গ্রহণ করা যাবে না। আমরা আসলে জানি কি প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের কতটুকু তেলের প্রয়োজন। প্রাপ্তবয়স্ক = ২০ গ্রাম ভেজিটেবল ফ্যাট, গর্ভবতী মা ৩০ গ্রাম ভেজিটেবল ফ্যাট, দুগ্ধদানকারী মা ৪৫ গ্রাম ভেজিটেবল ফ্যাট ।
অতিরিক্ত তেল গ্রহণ । ডুব তেলে ভাজা খাবার।ঘি । মাখন, পনির, মেয়নেজ, ফাস্টফুড। পোলাও, কাচ্চি, গরু ও খাশির মাংস ।ভুনা খাবার।অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার।
অতিরিক্ত গরম ও ঠাণ্ডা খাবার।
গ্রহণ করুন-
১. অল্প তেলে রান্না খাবার। প্রতিদিন ৩টির বেশ তরকারি গ্রহণ করবেন না। কারণ খাদ্য তালিকায় রান্না করা খাবার যত বাড়াবেন তত বেশি তেল খাওয়া হবে তত বেশি পেট ভরে খাওয়া হবে, তাই সাদা ভাতের সঙ্গে করলা ভাজি, পাতলা আম ডাল ও মাছ/মুরগির ঝোল তরকারি যথেষ্ট। সঙ্গে সালাদ লেবু, রসালো ফল ও টকদই রাখতে পারেন। তাজা খাবার গ্রহণ করুন, বাসি খাবার পরিহার করুন। উদাহরণ : ৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিটি পরিবার এই গরমে দিনে ৩-৪ টেবিল চামচ অর্থাৎ ৬০ এমএল তেল ব্যবহার করুন। খাবারের বৈচিত্র্য যাই হোক না কেন তেলের ব্যবহার ৬০ এমএল অতিক্রম করবেন না। কারণ শুধু তেল থেকে ক্যালরি পাচ্ছে ৬০›৯ = ৫৪০। গরমে এটিই যথেষ্ট নয় কি? মাসের তেলের মোট ব্যবহার হওয়া উচিত ১৮০০ এমএল. প্রায় ২ লিটার। পাশাপাশি তেল খরচও কমে গেল। অবশ্য শিশু ও গর্ভবতী মা, দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য পরিমাণ কিছুটা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবার মাসে ১০ লিটার থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত তেল গ্রহণ করে থাকে। এতে আপনার পরিবারের সদস্যদের গরমে অস্বস্তির পাশাপাশি শরীরে ওজন বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ সব শেষে কিডনি পর্যন্ত অকেজো হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই গরম থেকেই কম তেলের ব্যবহার শুরু করলে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করুন।
২.কোমল পানীয়ের পরিবর্তে ডাবের পানি গ্রহণ করুন।
৩.ফ্রিজের ঠাণ্ডা তরল খাবেন না। এতে গরমে অস্বস্তি আরও বাড়বে। তরমুজের শরবত, বাঙ্গির শরবত, টক দইয়ের শরবত, বেলের শরবত পান করুন।
প্রোটিন :
মনে রাখবেন শরীরে প্রোটিনের চাহিদা গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য ১ গ্রাম প্রোটিন ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ কেজি শরীরের ওজনের জন্য ৬০ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। [কিডনি রোগ ব্যতিত] গরমে মাংস (গরু, খাসি) পরিহার করে এর পরিবর্তে ছোট মাছ, পাতলা ডাল, টক দই, পাতলা দুধ, খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে হবে।
শর্করা :
শর্করা জাতীয় খাবারের দিকে একটু লক্ষ্য করুন। আপনি জানেন কি? আপনার শরীরে শর্করা জাতীয় খাবারের চাহিদা কতটুকু। এটি হচ্ছে মোট ক্যালরির ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ আপনার ওজন উচ্চতা, বয়স, শারীরিক পরিশ্রম লিঙ্গভেদে শক্তি চাহিদা যদি হয় ২০০০ ক্যালরি তবে তার ৬০ শতাংশ নিতে হবে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে। অর্থাৎ ১২০০ ক্যালরি। ১২০০ গু ৪ = ৩০০ গ্রাম শর্করা, এটি আপনি পাবেন ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, সুজি, সাগু, চিনি, আলু ও ফল থেকে। দুধ থেকেও আপনি শর্করা পাবেন। অনেকে ফল ও দুধ নিয়ে চিন্তিত হবেন, চিন্তামুক্ত হতে জেনে নিন- ফলে গড়ে ১৫ শতাংশ শর্করা থাকে, দুধে ১২ শতাংশ শর্করা থাকে। মনে রাখতে হবে, পাকা আমে ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রামে ৭৪ ক্যালরি পাওয়া যায়। আমে কোনো প্রোটিন বা ফ্যাট নেই। পুরোটাই শর্করা। হ্যাঁ তবে ভিটামিন ‘এ’ পাবেন প্রচুর। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ২৭৪৩ মাইক্রোগ্রাম ক্যারটিন পাওয়া যায়। গরমে শর্করার চাহিদা মিটাতে ভাত, রুটি, চিনির পরিমাণ কমিয়ে ফল, সবজি, দুধ, দই খাদ্য তালিকায় স্থান দিন।
ভিটামিন ও খনিজ উপাদান : গরমে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের চাহিদা মেটাতে টক ফল ও মিষ্টি ফল দুটোই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এছাড়া রঙিন শাকসবজি তো রয়েছেই। সুষম খাদ্যতালিকা থেকে (Balance Diet) আপনার খাদ্যের ৬টি পুষ্টি উপাদানের চাহিদাই পূরণ হবে।
পানি :
বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের কথা ভুলে গেলে চলবে না। প্রতিদিন ২.৫ লিটার পানি গ্রহণ যথেষ্ট। ৩ লিটার পর্যন্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে কিডনি রোগী ও ফ্লুয়িড রিটেনশন সিনড্রমের রোগীরা পানি গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক হোন ও আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।