যুদ্ধ মানেই নৈতিকতার মৃত্যু আর মানবতার পরাজয়ের গল্প। তবে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়গুলো থেকেই আবার বেরিয়ে আসে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর মানবতার ঘটনাগুলো। তেমনই এক ঘটনা ১৬ কেজি ওজনের এক কুকুরছানাকে হাঁটিয়ে, কখনো কোলে নিয়ে ২০ কিলোমিটার পথ হেঁটে আরিয়ার সীমান্তে পৌঁছানো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আরিয়ার যখন শরীর চলছিল না, তখন ওজন কমাতে নিজের সঙ্গে থাকা খাবার ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু কুকুরছানার খাবারটা ফেলেননি। মানুষ যখন নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য উড়োজাহাজে উঠতে হুড়োহুড়ি করছিল, আরিয়া তখন তাঁর কুকুরছানার জন্য খাঁচা খুঁজতে নিজের ফ্লাইট বাতিল করেছেন। অথচ এই কুকুরছানাকে সঙ্গে আনা নিয়ে অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। কেউ কেউ এটাকে আরিয়ার স্বার্থপরতা বলে মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকে প্রশংসাও করেছেন।
২০ বছরের মেডিকেল শিক্ষার্থী আরিয়া অলড্রিন সম্প্রতি তাঁর সাইবেরিয়ান কুকুরটি নিয়ে ইউক্রেন ছাড়েন। এটিকে যে রেখে আসা যেত, তা তাঁর মাথাতেই আসেনি। তাঁর প্রশ্ন, ‘যুদ্ধের মুখে যখন আপনি দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন, তখন কি আপনার প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে সঙ্গে নিয়ে আসা স্বার্থপরতা?’ তিনি মনে করেন, এটি করলে আরও বেশি স্বার্থপরতা হতো।পাঁচ মাস বয়সী কুকুরটির নাম জারিয়া। এটিকে নিয়েই আরিয়া হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালাতে পৌঁছান।
আরিয়ার ফেরাটা যে কতখানি কঠিন ছিল, তা এখন গণমাধ্যমের বরাতে জানে মানুষ।ইউক্রেনে থাকা অনেক ভারতীয় শিক্ষার্থীই ফেরার সময় তাঁদের পোষা কুকুর, বিড়াল সঙ্গে এনেছেন। কিন্তু রোমানিয়া সীমান্তের উদ্দেশে যখন তাঁরা বাসে করে যাচ্ছিলেন, সেখানে কুকুরকে কোলে নিয়ে আরিয়ার একটি ছবি ভাইরাল হয়।যুদ্ধের মুখে যখন আপনি দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন, তখন কি আপনার প্রিয় পোষা প্রাণীটিকে সঙ্গে নিয়ে আসা স্বার্থপরতা?’আরিয়া অলড্রিনএ নিয়ে অনেকে আরিয়ার প্রশংসা করেছেন আবার অনেকে ট্রল করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর মা-বাবা তাঁকে ইউক্রেনে পড়তে পাঠিয়েছেন নাকি পশুপাখির দেখভাল করতে? আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধের মধ্যে যেখানে মানুষের জীবন হুমকির মুখে, সেখানে উদ্ধারকারী ফ্লাইটে ভারতীয় সরকার কীভাবে প্রাণীদের আনার বিষয়টি অনুমোদন করল?আরিয়া বলেন, ‘আমি একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী। আমাদের বলা হয়, কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই জীবন বাঁচাতে। এমন না যে এটিকে রেখে এলে কেউ তাকে সাহায্য করত। ’
আমি তাকে ছেড়ে আসতে পারিনি
২০২০ সালে আরিয়া ইউক্রেনের বিনিৎজাতে ন্যাশনাল পিরোগভ মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যান। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে কেরালার অনেককে পেয়ে যান এবং সবার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।একপর্যায়ে ওজন কমানোর জন্য আরিয়া সঙ্গে থাকা খাবার ফেলে কমিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু জারিয়ার খাবারে হাত দেননি। ১০-১২ কিলোমিটার পথ জারিয়াকে কোলে নিতে হয়েছে আরিয়ার।আরিয়া পশুপাখি পছন্দ করেন জানতে পেরে গত ডিসেম্বরে এক বন্ধু তাঁকে দুই মাসের সাইবেরিয়ান হাস্কি প্রজাতির এক কুকুরছানা উপহার দেন। আরিয়া নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এটির নাম দেন জারিয়া। খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এমন অবস্থা যে আরিয়া ক্লাসে গেলে জারিয়া না খেয়ে কখন আরিয়া ফিরবে সেই অপেক্ষায় থাকে। আবার আরিয়াও অনেক সময় বন্ধুদের দাওয়াতে সাড়া দেন না। কারণ, তাঁর অনুপস্থিতিতে জারিয়াকে একা থাকতে হবে।
যখন ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত শুরু হলো তখনই আরিয়া ঠিক করে, যা-ই হোক না কেন, জারিয়াকে ফেলে তিনি যাবেন না। বন্ধু ও স্বজন অনেকেই বলেছেন, কিছুদিনের জন্য জারিয়াকে কারও কাছে দিয়ে চলে আসতে। কিন্তু তিনি মানেননি। আরিয়া বলেন, ‘আমি জানি, আমার মতো কেউ তার দেখভাল করবে না।’যখন সিদ্ধান্ত হলো ইউক্রেন ত্যাগ করতেই হবে, তখন আরিয়ার মা জারিয়াকে নিয়ে আসার বিষয়ে সম্মতি দিলেন। তাঁর বাবাও প্রথমে অমত করলে পরে রাজি হন। এই সংকটের মধ্যেও আরিয়া এক দিনের মধ্যে পোষা প্রাণীর পাসপোর্টে, টিকা সনদ ও মাইক্রোচিপের ব্যবস্থা করেন। দেশটির পোষা প্রাণিবান্ধব নীতিমালা ও কর্মকর্তাদের সহায়তাতেই এটি সম্ভব হয়েছে বলে জানান আরিয়া।
আরিয়া জারিয়াকে নিয়ে একটি গ্রুপের সঙ্গে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিনিৎজা ছাড়েন। পরদিন তাঁদের একটি বাসে করে রোমানিয়া সীমান্তে নেওয়া হয়। হট্টগোল ও অপরিচিত লোকজনের মধ্যে জারিয়া তার নির্ভরতার জায়গা আরিয়ার কাছে বেশ শান্তভাবেই ছিল।ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। আরিয়াদের বহনকারী বাসটি ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সীমান্ত থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে থাকতেই বাসের চাকা থেমে যায়। কারণ, সীমান্তকে কেন্দ্র করে তাঁদের গাড়ির সামনে লম্বা লাইন। এরপর তাঁরা বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকেন। আসার সময় আরিয়া ও তাঁর বন্ধু নিজেদের জন্য জুস ও বিস্কুট এবং জারিয়ার জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন। দীর্ঘ পথ চলতে চলতে আরিয়ার মাসিক হয়ে যায়। তার পিঠব্যথা শুরু হয়। ততক্ষণে জারিয়াও খুব ক্লান্ত। এটিও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। আরিয়া তখন বুঝতে পারল জারিয়ার কষ্ট হচ্ছে, তাকে কোলে নিতে হবে।
জারিয়ার ওজন ১৬ কেজি হওয়ার পরও আরিয়া তাকে কোলে তুলে নেয়। তিনি বলেন, ‘কোলে নিতেই বাচ্চাদের মতো এটি আমার কাঁধে ঘুমিয়ে গেল।’দীর্ঘ কষ্টের এই সফরে গ্রুপের অন্যরা তাঁকে সাহায্য করেছেন। কখনো কখনো আরিয়াকে থামতে হয়েছে। নিজের হাতকে বিশ্রাম দিয়েছেন। একপর্যায়ে ওজন কমানোর জন্য আরিয়া সঙ্গে থাকা খাবার ফেলে কমিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু জারিয়ার খাবারে হাত দেননি। ১০-১২ কিলোমিটার পথ জারিয়াকে কোলে নিতে হয়েছে আরিয়ার।ফ্লাইটটে ওঠার অল্প সময় আগে রোমানিয়া কর্তৃপক্ষ আরিয়াকে জানায়, জারিয়াকে খাঁচায় করে নিতে হবে। ফলে আবার আরিয়ার দৌড় শুরু। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে খাঁচার জোগাড় করতে লেগে যায় আরও কয়েক ঘণ্টা। ছেড়ে দিতে হয় আরও একটি ফ্লাইট।
রোমানিয়া সীমান্তে যখন পৌঁছান, তখন আরিয়ার কাছে শুধু ছিল জারিয়ার খাবার ও ভ্রমণের কাগজপত্র। সেখানেও প্রায় সাত ঘণ্টা তাঁকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।
যখনই সীমান্তের ফটক খুলছিল, তখনই প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি লেগে যাচ্ছিল। একবার আরিয়া জারিয়াকে নামাতে গেলে তার গায়ে লাথি লাগে এবং ব্যথায় এটি কুঁকড়ে ওঠে।আরিয়া বলেন, ‘আমি কোনো রকমে এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি জারিয়াকে জাপটে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম আর কাঁদছিলাম। মনে হয়েছে, বিনিৎজাতে ফিরে যেতে পারলে ভালো হতো।’
অপেক্ষায় থাকার সময় পরিস্থিতি দেখে আরিয়াকে একপর্যায়ে জারিয়ার খাবারও কমাতে হলো। একপর্যায়ে পরিস্থিতি অসহনীয় লাগছিল। শেষ পর্যন্ত যখন তাঁদের পালা এল, তখন তাঁর বন্ধু সীমান্তের দরজা পার করতে পারলেও আরিয়া ও জারিয়া একদল শিক্ষার্থীর ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে যায়। তখন তিনি জারিয়াকে ওপরে তুলে ধরলে এক ইউক্রেনীয় সেনার নজরে পড়ে। তিনি পরে তাঁদের সীমান্ত পার করিয়ে দেন। আরিয়া বলেন, ‘যখন সীমান্ত পার হচ্ছিলাম, সেই স্বস্তির অনুভূতি বোঝাতে পারব না।’
সীমান্ত অতিক্রম করার পর প্রথমে তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের খাবার ও পানি দেওয়া হয়। এমনকি আরিয়ার পায়ে থাকা জুতাগুলোর দুর্দশা দেখতে পেয় স্বেচ্ছাসেবীদের বেশ মায়া হয়। তাঁরা তাঁকে ব্যবহৃত এক জোড়া জুতাও দেন। সেখানে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তাঁদের বুখারেস্টের কাছে হেনরি কোন্ডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রোমানিয়া পুলিশ জারিয়াকে দেখে বেশি খাবার ও টিস্যু দেয় এবং বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য একটি ট্যাক্সি ডেকে দেয়।
এইবার পালা বাড়ির উদ্দেশে ফ্লাইট ধরা। মনে মনে আরিয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন যে সব ক্লান্তি ও ভোগান্তির শেষ হলো। কিন্তু তা আর হয়নি। ভারত সরকারের ব্যবস্থাপনায় যে ফ্লাইটটি ছিল, তাতে ওঠার অল্প সময় আগে রোমানিয়া কর্তৃপক্ষ আরিয়াকে জানায়, জারিয়াকে খাঁচায় করে নিতে হবে। ফলে আবার আরিয়ার দৌড় শুরু। এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে খাঁচার জোগাড় করতে লেগে যায় আরও কয়েক ঘণ্টা। ছেড়ে দিতে হয় আরও একটি ফ্লাইট।
ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া অনেকেই তাদের পোষা প্রাণীকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। পোল্যান্ডের এক শরণার্থী শিবির থেকে ছবিটি ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলাইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া অনেকেই তাদের পোষা প্রাণীকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাচ্ছেন। পোল্যান্ডের এক শরণার্থী শিবির থেকে ছবিটি ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলাফাইলঅবশেষে আরিয়া দিল্লিগামী আরেকটি ফ্লাইটে উঠতে সক্ষম হন। সেখানে তাঁকে কিছু খাবার দেওয়া হয়। আরিয়া একটু খেয়ে বাকিটা জারিয়ার জন্য রেখে দেন, যেন ফ্লাইট থেকে নামলেই জারিয়াকে খাওয়াতে পারেন।
কিন্তু দিল্লিতে নামার পর আবার আরিয়াকে ফ্লাইট বাতিল করতে হয়। কারণ, এয়ার এশিয়ার ওই ফ্লাইট প্রাণী বহন করে না। তাই আরিয়াকে নতুন করে অন্য ফ্লাইট নিতে হয়। এরই মধ্যে আরিয়ার এই সফর খবরে পরিণত হয়। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী আরিয়ার প্রশংসা করে ফেসবুকে নোট লেখেন।পরের দিন আরিয়া যখন কোচি বিমানবন্দরে পৌঁছান, একদল সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন।আরিয়া বাড়ি ফেরার পথে প্রথমে জারিয়াকে একজন পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং টিকা দেওয়ান। এরপর পাহাড়ি এলাকা মুন্নারে বাড়ির পথে রওনা হন।
সাইবেরিয়ান হাসকি প্রজাতির এই কুকুরগুলোর গায়ে মোটা পশম থাকে, যা তাদের প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এখন কেরালার উষ্ণ পরিবেশে এটিকে বেশ বেগ পেতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আরিয়া বলেন, জারিয়া ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। কারণ, কেরালার অন্য অংশের তুলনায় মুন্নার তাপমাত্রা কম। এখন জারিয়া আরিয়ার মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটায় বলে হাসতে হাসতে জানান আরিয়া।