খাগড়াছড়ির সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হ্যাপি চাকমাকে মাসে কম করে হলেও ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিটর করতে যেতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে অবস্থিত, তার কোনো কোনো এলাকায় পানি নেই। কোনো কোনো জায়গায় শৌচাগার নেই। পাহাড়ি রাস্তা তো আছেই। গত আট বছরের মধ্যে তিন বছর আগেও হ্যাপি চাকমা মাসিকের দিনগুলোতে আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার পরও কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে গেল কি না, সারা দিনের মধ্যে এই প্যাড পাল্টাতে পারবেন কি না, পাল্টালে তা কোথায় ফেলবেন ইত্যাদি ভাবনা মাথা থেকে দূর করতে পারতেন না। তবে তিন বছর ধরে শরীরের সঙ্গে মানানসই সিলিকনের মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করে তিনি মাসিকের সময়টা নিশ্চিন্ত থাকছেন।
শুধু হ্যাপি চাকমা নন, বর্তমানে শহুরে, শিক্ষিত এবং সচেতন নারীরা স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পুনের চেয়ে কাপ ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে সংখ্যাটা এখনো কম। অনেকের মধ্যে যোনিপথে কাপ ঢুকিয়ে ব্যবহারে ভয়ও কাজ করে। অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে, এটা যদি যোনিপথ দিয়ে শরীরের মধ্যে ঢুকে যায় তখন কী হবে।
তবে যে নারীরা কয়েক বছর ধরে এই কাপ ব্যবহার করছেন তাঁরা বলছেন, শুরুতে দুই থেকে তিন মাস এটি ব্যবহারে অস্বস্তি কাজ করে। তখন কাপ ব্যবহারের পাশাপাশি স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হতে পারে। শুরুতে ঠিকমতো অনেকেই এটি পরতে পারেন না। তবে একবার কেউ ব্যবহার করলে তিনি আর সহজে স্যানিটারি প্যাড বা অন্য কোনো কিছুতে ফেরত যাচ্ছেন না। বিশেষ করে খেলোয়াড়, সাইক্লিং করা নারী বা যে নারীদের বাইরে বিরূপ পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হচ্ছে তাঁরা বলছেন, কাপ ব্যবহারে তাঁদের মাসিক নিয়ে আর কোনো ভোগান্তি হচ্ছে না। শৌচাগার ব্যবহার করার সময়ও কাপ খুলতে হচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করা, সাঁতার কাটার সময়ও কাপ কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে না।
বাংলাদেশে এখনো যে নারীরা কাপ ব্যবহার করছেন, তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং ইউটিউব থেকে জেনে ব্যবহার করছেন। কেউ কেউ অন্য নারীদের সুবিধার জন্য ব্যক্তিগতভাবে ভারত, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কাপগুলো এনে ব্যক্তিগতভাবে বিক্রি করছেন। তবে এর মধ্যে অনেকে নিম্নমানের বা অনুমোদিত সংস্থার অনুমোদন নেই, এমন কাপও বিক্রি করছেন। ফলে নারীরা ব্যবহার করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকছে। তাই কাপ ব্যবহারকারী নারী এবং এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা চিকিৎসকেরা বলছেন, বিদেশ থেকে যেসব কাপ দেশে এনে বিক্রি করা হচ্ছে, তার গুণগতমান যাচাইয়ের একটি ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
ফেসবুকে মেন্সট্রুয়াল কাপ বাই মাম্বল গ্রুপ পরিচালনা করছেন উন্নয়নকর্মী নাহিদ আখতার দীপা। প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তিনি মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে কথা বলছেন
ফেসবুকে মেন্সট্রুয়াল কাপ বাই মাম্বল গ্রুপ পরিচালনা করছেন উন্নয়নকর্মী নাহিদ আখতার দীপা। প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তিনি মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে কথা বলছেনছবি: দীপু মালাকার
খাগড়াছড়ির হ্যাপি চাকমা বলছিলেন, তিনি অনলাইন থেকে প্রথম যে কাপটি কিনেছিলেন, তার মান ভালো ছিল না। ছোট একটি পার্সের মধ্যে কাপটি দিয়েছিল। দেখেই তা আর ব্যবহার করতে ইচ্ছে করেনি। তবে পরে যেটি কেনেন, তা তাঁর মনমতো হয়। একেকটি কাপের যেহেতু দামটা বেশ বেশি তাই কাপ কিনে কেউ ঠকে গেলে তা গায়ে লাগে। আর স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই।
হ্যাপি চাকমা নিজে কাপ ব্যবহারের পর ভালো লাগায় তিনি তাঁর স্বজন ও পরিচিতজনদের জন্যও মোট পাঁচটি কাপ কিনেছেন বলে জানালেন। এর মধ্যে তাঁর অবিবাহিত ছোট বোনও আছেন।
দাঁতের চিকিৎসক শামীমা ইসলাম দুই বছর ধরে কাপ ব্যবহার করছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর দুই অবিবাহিত ননদও কাপ ব্যবহার করছেন। কোনো গবেষণা বা প্রবন্ধে কাপ ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে, তা এখন পর্যন্ত তাঁর নজরে আসেনি বলেও জানালেন।
স্পেকটার্ম অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা জেবুন নেসাও দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাপ ব্যবহার করছেন। বললেন, এখন মাসিক হলেও কাপ ব্যবহারের কারণে মাসিকের কথাই মনে থাকে না। আর নারীদের অনেকে নিজের শরীর সম্পর্কেও তেমন কিছু জানেন না। তাই ভাবেন যোনিপথের ভেতরে কাপ ঢোকানোর পর তা শরীরের মধ্যে ঢুকে যাবে। কিন্তু কাপটা ভেতরে ঢোকার তো কোনো পথই নেই।
সাইক্লিং করেন জেবুন নেসা। তিনি জানালেন, মাসিক শেষ হলে কাপ ব্যবহারের পর গরম পানিতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট ফুটিয়ে তা শুকিয়ে রেখে দিতে হয়। তবে তিনি একবার গরম পানিতে ফুটতে দিয়ে ভুলে গিয়েছিলেন, ফলে কাপটি পুড়ে যায়। তাই আবার নতুন করে কিনতে হয়।
নিরাপদ মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নাহিদ আখতার দীপা। তিনি ফেসবুকে মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে মেন্সট্রুয়াল কাপ বাই মাম্বল নামের একটি গ্রুপ পরিচালনা করছেন। এতে ১৫ হাজার সদস্য। নাহিদ নিজে কাপ ব্যবহারের পর এই গ্রুপের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে ভারত এবং ডেনমার্ক থেকে কাপ এনে বিক্রি করছেন। বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকার মধ্যে (এফডিএ অনুমোদিত) এই কাপগুলো পাওয়া যাচ্ছে। এ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে প্রায় ছয় হাজার নারী এই কাপ কিনে ব্যবহার করছেন বলে জানালেন। এ পর্যন্ত মাত্র ছয়জন কাপ ব্যবহারে কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন। নাহিদ নিজ উদ্যোগে বাংলায় একটি ম্যানুয়াল গাইডলাইন তৈরি করেছেন।
আফ্রিকায় নারীরা এই কাপ ব্যবহার করছেন। সন্তানের জন্মের আট মাস পর যখন মাসিক শুরু হয় এবং প্রচণ্ড রক্ত যাচ্ছিল তখনই নাহিদ দীপা কীভাবে এই সময় একটু স্বস্তি পেতে পারেন, তা খোঁজা শুরু করে এই কাপের কথা জানতে পারেন।
নাহিদ জানালেন, বিশ্বের অন্যতম মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট ২০১৯ সালে উন্নত, অনুন্নতসহ ২০টির বেশি দেশের ৩ হাজার ৩১৯ জন নারী ও কিশোরীর কাপ ব্যবহার নিয়ে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ৪৩টি গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। এ নিবন্ধে বলা হয়েছে, নারীরা কাপ ব্যবহার শুরুর পর তাঁরা তা নিয়মিত ব্যবহার করছেন। নাহিদও জানালেন, এখন পর্যন্ত কাপ ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে তেমন কিছু তাঁর নজরে আসেনি।
নাহিদ প্রথম কাপ ব্যবহার করেন ২০১৮ সালে। তাঁর কাপ ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পাঁচ মাস সময় লেগেছিল। তিনি বললেন, ২০১৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মাসিকের পেছনে খরচ বলতে তিনি দুটি কাপ কিনেছেন। তিনি জানালেন, মাসিকের সময় বাড়তি সাবান লাগে না। ব্যবহারের পর কাপ ধোয়ার জন্য ৫০ এমএল পানি হলেই চলে। মাসিকের প্রথম দুই–তিন দিন তিন ঘণ্টা পরপর একবার পরিষ্কার করে নিলেই হয়।
নাহিদ দীপার মতে, দেশের পোশাকশিল্প কারখানার নারী শ্রমিক, উপকূলে যেখানে পানির তীব্র সংকট সেসব এলাকার নারীদের জন্য কাপ ব্যবহার খুবই উপকারী হবে। তবে বড় পরিসরে কাজ শুরুর আগে অবশ্যই পাইলটিং করতে হবে। এ কাজে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারে। কেউ এগিয়ে এলে তিনি নিজেও নারীদের এটি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সার্বিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছেন।
সিটি ডেন্টাল কলেজের প্রভাষক চিকিৎসক আতিক মেহদী তাঁর ফেসবুক পেজে করোনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করছেন। কোনো একটি বিষয়ে ভিডিও প্রচারের আগে তিনি বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করছেন, যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। ১ মে তিনি তাঁর পেজে ভিডিওতে কথা বলেছেন মেন্সট্রুয়াল কাপ নিয়ে।
আতিক মেহদী প্রথম আলোকে বলেন, মেন্সট্রুয়াল কাপটি গোপনীয় কোনো বিষয় নয়, নারীরা পরিবেশ এবং নিজেদের স্বস্তির জন্য কাপ ব্যবহার করতে পারেন, কাপ ব্যবহারের সুবিধা বা অসুবিধা আছে কি না, তা জানানোর জন্যই তিনি ভিডিওটি আপ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী কয়েক বছর ধরে কাপ ব্যবহার করছেন, তিনিও এ বিষয়ে কিছু বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।
আতিক মেহদী বলেন, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রজননক্ষম নারী ও মেয়ের সংখ্যা ২৪ শতাংশ। এই মানুষগুলো প্রতিদিন ট্যাম্পুন এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন। এতে প্লাস্টিকের পরিমাণ থাকে একেকটি শপিং ব্যাগের চার গুণ। এই প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে অর্থাৎ পুরো জীবনে গড়ে ৫ থেকে ১০ হাজার স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। ফলে সংখ্যাটা সহজেই অনুমেয়।
আতিক মেহদীর দেওয়া তথ্য বলছে, লিওনা নামের একজন অভিনেত্রী ১৯৩৭ সালে নিজে ব্যবহারের জন্য এ ধরনের কাপ উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি তাঁর উদ্ভাবন একটি কোম্পানিকে দিয়ে দেন। তবে সামাজিক বাস্তবতায় ওই কোম্পানি এটা নিয়ে কাজ করতে পারেনি এবং পরে কোম্পানিটিই বন্ধ হয়ে যায়।
কাপের সুবিধা সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রভাষক আতিক মেহদী বলেন, প্রায় আড়াই হাজার স্যানিটারি প্যাডের বিকল্প হতে পারে একটি মেন্সট্রুয়াল কাপ। একটি কাপ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করলে ২ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। এটি দ্রুত ফেলে দিতে হয় না, বারবার ব্যবহার করা যায়, ফলে তা পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর। ট্যাম্পুন এবং স্যানিটারি প্যাড মাসিকের সময় রক্ত শুষে নেয় কিন্তু কাপ শুধু মাসিকের রক্ত কাপে জমা রাখে। কাপ পরলে একটানা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত তা রক্ত জমা করতে পারে। কাপ ব্যবহারে নারীর প্রজনন অঙ্গ স্যাঁতসেঁতে থাকে না, গরম কম লাগে। ব্যাকটেরিয়া এবং অন্য কোনো অ্যালার্জি হয় না। অন্য দিকে ট্যাম্পুন এবং স্যানিটারি প্যাড যখন রক্ত শুষে নেয়, তখন ভ্যাজাইনাল ফ্লুইড, ভালো ব্যাকটেরিয়াকেও শুষে নেয়। কাপের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে মাসিকের রক্ত বাইরে বের হয়ে বাতাসের সংস্পর্শে আসতে পারে না বলে বাজে গন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাপ বের করে ধুয়ে আবার ব্যবহার করতে পারছেন নারীরা।
তবে আতিক মেহদী কাপ ব্যবহারে নারীদের সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, কাপ পরা এবং বের করার সময় অবশ্যই হাত পরিষ্কার থাকতে হবে। কাপ ধোয়া এবং সংরক্ষণের পদ্ধতি মানতে হবে। আর কাপটি যথাযথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত কি না, তা–ও দেখে কিনতে হবে। বাংলাদেশে কাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লে দেশের বাইরে থেকে আসা কাপগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।