দেশে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়ে চলমান তৃতীয় ঢেউ অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এপ্রিলে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঢেউ চূড়ায় উঠতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত দিন। সেখানে
তৃতীয় ঢেউ গত দেড় মাসেও চূড়ায় উঠতে পারল না। বরং গত আট দিন ধরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ধীরগতির কারণে মৃত্যু, রোগী ও শনাক্ত হার বাড়ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিদিনই ভাঙছে আগের রেকর্ড। উদ্বেগজনক সংখ্যক মানুষ করোনা শনাক্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। শনাক্ত হার প্রতিদিনই বাড়ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের করোনা পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আবার এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী ও মৃত্যুর জোড়া রেকর্ড হয়েছে। গতকাল সোমবার আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯৬৪ ও মারা গেছে ১৬৪ জন। এর আগের দিন সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ১৫৩ ও রোগী ছিল ৮ হাজার ৬৬১ জন।
এ সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল বেশি উদ্বেগের। কারণ গতকালই দেশে প্রথম এক দিনে আগের যেকোনো দিনের চেয়ে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩০০ তিনজন বেশি রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দিয়ে মাত্র ৯ দিনে রোগী বাড়ল দ্বিগুণ। এমনকি এই প্রথম এক দিনে দেশে প্রায় ১০ হাজার রোগী শনাক্তের ঘটনা ঘটল।
পাশাপাশি শনাক্তের হার গতকালও বেড়েছে। আগের দিন গত রবিবার পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গতকাল তা ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশে উঠেছে। এমনকি গত ১৫ দিন ধরে শনাক্তের হার ক্রমেই বাড়ছে। ২১ জুন এই শনাক্ত ছিল ১৯ শতাংশ। বাড়তে বাড়তে গতকাল তা ২৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ১১ মাস আগে দেশে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ শনাক্ত ছিল এক দিন। জুনের আগে শনাক্ত হার ২৩-২৫ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করেছে। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে শনাক্ত হার আর কমছে না।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি খুলনা ও ঢাকা বিভাগের। গতকালও খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ও আক্রান্ত হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৭০ জন। ঢাকা বিভাগে মারা গেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ ও আক্রান্ত হয়েছে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২৫০ জন।
এমন অবস্থায় দেশের করোনা পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একসময় শহরাঞ্চলে সংক্রমণ বেশি ছিল। এখন গ্রামাঞ্চলে বেশি। অথচ গ্রামের মানুষ এখনো সচেতন নয়। তারা এখনো মনে করে করোনা শহরের মানুষের জন্য। ফলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে।
মানুষ চলমান ‘লকডাউন’ মানছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রধান সড়ক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে লোকজন দেখা না গেলেও অলিগলি ও গ্রামে এখনো মানুষ যত্রতত্র বেরোচ্ছে। বিশেষ করে মাস্ক পরছে না কেউই। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা শতভাগ মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা বলছেন, ‘লকডাউন’ শিথিল হচ্ছে। মানুষ মানছে না। এমন অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক অপরিহার্য।
গ্রামের মানুষের কারণে রোগী ও মৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের সামাজিক বিস্তার ঘটায় কভিড ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামপর্যায়ে। গ্রামের রোগীরা অসতর্ক, গ্রামের বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে আসেন অনেক পরে, এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই তথাকথিত লকডাউন খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কেননা মানুষ তো পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো মানুষের মুখে এখন মাস্ক নেই। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে সংক্রমণ তো কমবেই না, উল্টো বাড়বে।’
পরিস্থিতি এপ্রিলের চেয়ে ভয়াবহ : এপ্রিলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়ে গত ১৯ মে থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় ঢেউ অনেক বেশি মারাত্মক ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। এপ্রিলে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঢেউ চূড়ায় উঠতে সময় লেগেছে মাত্র সাত দিন। ১ এপ্রিল যেখানে রোগী ছিল ৬ হাজার ৪৬৯, সেখানে সর্বোচ্চ চূড়ার দিন ৭ এপ্রিল রোগী শনাক্ত হয় ৭ হাজার ৬২৬ জন, মারা যায় ৬৩ জন ও শনাক্ত হার ছিল ২২ শতাংশ। সেখানে ১৯ মে থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় ঢেউ গত দেড় মাসেও চূড়া পেল না। উল্টো তৃতীয় ঢেউয়ের সর্বশেষ গতকাল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৯৬৪ জন রোগী শনাক্ত ও সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়। এমনকি দ্বিতীয় চূড়ার শনাক্ত হার ২২ শতাংশ এখন ২৯ শতাংশের বেশি হয়েছে।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর ভয়াবহ ৯ দিন : গত ১৬ মাস ধরে দেশে করোনার মহামারী চলছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তৃতীয় ঢেউ উদ্বেগে ফেলেছে গোটা দেশকে। বিশেষ করে গত ৯ দিন ধরে পরিস্থিতি এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার ৯ দিনে অর্থাৎ ৪-১২ এপ্রিলের চেয়ে গত ৯ দিনে রোগী বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এপ্রিলের ওই ৯ দিনে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৮৫৩ জন, সেখানে গত ৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছে দৈনিক ৭ হাজার ৯৭১ জন করে।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার চেয়ে এখন রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারে বেশি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার ৯ দিনে মোট রোগী ছিল ৬১ হাজার ৬৮০ জন; সেখানে গত ৯ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৭১ হাজার ৭৪৩ জন।
একইভাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার ৯ দিনের তুলনায় গত ৯ দিনে দৈনিক মৃত্যু বেড়েছে ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার সময় যেখানে দৈনিক মারা যেত ৯৮ জন করে, এখন মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩১ জনে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চূড়ার ৯ দিনে মোট মৃত্যু ছিল ৮৯০, এখন তা ১ হাজার ১৭৬ জন হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় বেশি মৃত্যু খুলনা বিভাগে : বিভাগের দিক থেকে বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে খুলনা বিভাগে ৫৫ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে ৪০ জনের ও তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু চট্টগ্রামে ১৮ জন। এছাড়া রাজশাহী ও রংপুরে মারা গেছে ১৬ জন করে, বরিশালে ৯, সিলেটে ৮ ও ময়মনসিংহে ২ জন।
মোট মৃত্যু বেশি ঢাকায় : এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ঢাকা বিভাগে ৭ হাজার ৭৬৮ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ২ হাজার ৮৩৩, খুলনায় ১ হাজার ৪৯১, রাজশাহীতে ১ হাজার ১২৮, রংপুরে ৬৭৩, সিলেটে ৫৪৭, বরিশালে ৪৪৮ ও ময়মনসিংহে মারা গেছে ৩৪১ জন।
২৪ ঘণ্টায় বেশি মৃত্যু কুষ্টিয়া জেলায় : জেলার মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছে কুষ্টিয়ায় ১৬ জন। এছাড়া ঢাকায় ১৩, খুলনায় ১০, ঝিনাইদাহ ও বগুড়ায় ৭ জন করে, যশোর, টাঙ্গাইল ও মেহেরপুরে মারা গেছে ৬ জন। বাকি জেলাগুলোতে ৬ জনের কম মারা গেছে।
মোট মৃত্যুর বেশি ঢাকা জেলায় : এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ঢাকা জেলাতে ৫ হাজার ৫৭৫ জন। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় ৮৩৭, কুমিল্লায় ৭২৯, নারায়ণগঞ্জে ৪৬৬, বগুড়ায় ৩৭৫, খুলনায় ৩১৫, গাজীপুরে ৩০৯ ও কুষ্টিয়ায় ৩০৮ জন। বাকি জেলাগুলোতে ৩০০ জনের কম মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বেশি রোগী ঢাকায় : গত ২৪ ঘণ্টায় এবং এ পর্যন্ত মোট রোগীর বেশি শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগ ও ঢাকা জেলায়। ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে ৪ হাজার ২৫০ জন। এছাড়া খুলনায় ১ হাজার ৪৭০, চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩৬৭, রাজশাহীতে ১ হাজার ১২৩, রংপুরে ৬৭৬, বরিশালে ৪৩৬, ময়মনসিংহে ৩৮৯ ও সিলেটে ২৫৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
একইভাবে মোট রোগীর মধ্যে এখন পর্যন্ত বেশি রোগী ঢাকা জেলায়, ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪১১ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ৭৫৫, রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৪২৮, সিলেটে ১৭ হাজার ৪২৫, খুলনায় ১৬ হাজার ৫৫২, বগুড়ায় ১৪ হাজার ৬৭১, ফরিদপুরে ১৩ হাজার ৬২৫ ও গাজীপুরে ১৩ হাজার ৯২ জন রোগী পাওয়া গেছে। এছাড়া বাকি জেলাগুলোতে ১৩ হাজারের নিচে রোগী শনাক্ত হয়েছে।
শতভাগ মাস্ক অপরিহার্য : ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সরকার লকডাউন দিয়েছে মানুষকে ঘরে রাখার জন্য। কিন্তু মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘর থেকেও বের হলো, মাস্কও পরল না, মানে সরকারের সব আয়োজন বিফলে যাচ্ছে।’ করোনা নিয়ন্ত্রণে এ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন, মানুষকে শতভাগ মাস্কের আওতায় আনতে হবে। সেটা জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত তা বা প্রশাসন দিয়ে যেভাবেই হোক মাস্ক পরাতে হবে। মাস্ক না পরলে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।