আমি প্রার্থনায় ছিলাম, রক্তিম সুশীল ফিরে আসবেন। অন্তত মায়ের জন্য, পরিবারের জন্য। কিন্তু সেটা হলো না। ৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা পীড়াদায়ক। দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনার গবেষণা করতে গিয়ে আমি অনেক মর্মান্তিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু চকরিয়ার ঘটনার মতো এমন ঘটনা দেখিনি। বাবা মারা গেলেন। শোক করবে পরিবার। কিন্তু সেখানেও রক্ষা হলো না। সন্তানহারা মা মৃণালিনী সুশীলের ছবি দেখেছি। বাবাহারা বাচ্চাগুলোর কান্না অন্তরে বিঁধে।আমি অপেক্ষায় ছিলাম, যাঁরা পদে আছেন, যাঁদের দায়িত্ব সড়ক নিরাপদ করার, তাঁরা কী করেন। আশা করেছিলাম, তাঁদের কেউ অন্তত মৃণালিনী সুশীলের বাড়িতে যাবেন, ক্ষমা চাইবেন। না, কেউ এটা করলেন না। এ ঘটনায় আমি আরও বেশি আঘাত পেয়েছি। এটা লজ্জার।
মৃণালিনী সুশীলের বাড়িতে কে যেতে পারতেন, কী বলতে পারতেন? আমি আশা করেছিলাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান গিয়ে বলবেন যে, ‘আমি চালকের লাইসেন্স দিই। যানবাহন ত্রুটিমুক্ত রাখার দায়িত্ব আমার। আমি পারলাম না, ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’হাইওয়ে পুলিশের পেছনে বিনিয়োগ হয়েছে। তাদেরও তো সড়ক নিরাপদ করার দায় আছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) গিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সেই প্রতিজ্ঞা থাকতে পারত।কিন্তু কেউ গেলেন না। কারও টনক নড়েনি। কেন আমরা এত নিষ্ঠুর হলাম? এটা ভেবে আরও কষ্ট পাচ্ছি।চকরিয়ায় দুর্ঘটনার পর চালককে ধরেছে পুলিশ। যেন তাঁর একারই সব দোষ। সড়ক যে নির্মাণ করল, তার কি কোনো ত্রুটি নেই? কেউ কি তা তদন্ত করে দেখেছে? যে পিকআপটি দুর্ঘটনা ঘটাল এর মালিকের কি কোনো দায় নেই? চালকের কি লাইসেন্স আছে? থাকলে সেই লাইসেন্স কি যথাযথ দক্ষতার পরীক্ষা নিয়ে দেওয়া হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে শুধু চালককে ধরলেই সমাধান হবে না।
চকরিয়ার মতো শোকের ঘটনার পর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, যে যে ত্রুটি পাওয়া গেছে, তা সারানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। সারা বিশ্বে সেটাই হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা দেখা যায় না। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ৪৪ জন শিক্ষার্থী মারা গেল। ২০১২ সালে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর সড়কে প্রাণ হারালেন। এরপর নরসিংদীতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নয়জন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন। সর্বশেষ শহীদ রমিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশে ছাত্র আন্দোলন হলো। কিছু এলাকাভিত্তিক কাজ হয়েছে। কিন্তু পুরো ব্যবস্থার কি কোনো সংস্কার হয়েছে? হয়নি।মিরসরাইয়ের ঘটনার পর আমি তদন্ত করে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। এর মধ্যে ট্রাকে যাত্রী পরিবহন করা যে অবৈধ, সেটা ছিল। কিন্তু আজও কি ট্রাকে মানুষ পরিবহন বন্ধ হয়েছে? মিরসরাইয়ের যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানটায় সড়কের বর্ধিতাংশ (শোল্ডার) ঠিক ছিল না।
এর জন্য সড়ক নির্মাতা দায়ী। সড়ক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাউকে ভর্ৎসনা করারও কোনো ঘটনা ঘটেনি। একটি অবৈধ নছিমনকে জায়গা দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীবাহী ট্রাকটি উল্টে খাদে পড়ে গিয়েছিল। অবৈধ নছিমন কি বন্ধ হয়েছে? ট্রাকের মালিক সহকারীকে ট্রাকটি চালাতে দিয়েছিলেন। এ প্রথা কি বন্ধ হয়েছে? তাহলে কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে, মানুষের কান্না থামবে? এখন কে বাদ আছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ছাত্র-শিক্ষক, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পাঠানো ব্যক্তি—পরিসংখ্যানে কোনো শ্রেণিই তো বাদ যাচ্ছে না।আমি অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম। এ জন্য করলাম যে এর আগে আমিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ বহু পরামর্শ দিয়েছেন। হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, চেয়ারে বসে আছেন, তাঁদের কোনো ভাবাবেগ নেই। তাঁদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। তাহলে আমরা এত বড় স্বপ্ন কেন দেখছি? একটি উন্নত দেশ, সমাজের স্বপ্ন দেখা কতটা বাস্তবসম্মত।সামছুল হক, অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)