ঘটনা ২০২০ সালের। সে বছর অভিনব এক প্রতারণার শিকার হন আক্তারুজ্জামান নামের গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী। একটি কয়েন বিক্রির কথা বলে তাঁর কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা নিয়ে নেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। তবে ওই কয়েন তিনি চোখেই দেখেননি। কয়েনের বদলে তাঁকে যা দেখানো হয়েছিল, তা ছিল কিছু চাল। আক্তারুজ্জামানকে বলা হয়, কয়েনটির সংস্পর্শে থাকায় ওই চাল এখন মূল্যবান। সেগুলো পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে কয়েনটি আসল।
প্রতারণার শিকার হওয়ার পর গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর পল্লবী থানায় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা করেন আক্তারুজ্জামান। মামলায় আসামি করা হয় ঝিনাইদহের এস এম সেলিমুজ্জামান (৪৩), সিরাজগঞ্জের হাবিবুর রহমান (৪২) ও শাহ আলী (৩৭) এবং ঢাকার হালিম তালুকদারকে (৪৫)।
মামলায় সেলিমুজ্জামান, হাবিবুর ও শাহ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক মাস কারাভোগের পর জামিনে ছাড়া পান তাঁরা। আদালতে আসামিরা দাবি করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আনা প্রতারণার অভিযোগ সঠিক নয়। তবে পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
আক্তারুজ্জামানের করা ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা মামলার চার আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিল। তদন্ত করতে গিয়ে চারজনের মানি লন্ডারিংয়ের তথ্যও জানতে পারে সিআইডি। এ নিয়ে শুরু হয় অনুসন্ধান।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান শেষে গত ২২ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন সিআইডির পরিদর্শক মেহেদী মাকসুদ। প্রতারকদের লেনদেনসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় অপরাধ।
এ বিষয়ে মামলার বাদী সিআইডি কর্মকর্তা মেহেদি মাকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্যরা অনেক ধূর্ত। তাঁরা কয়েন বিক্রির কথা বলে ব্যবসায়ী আক্তারুজ্জামানের কাছ থেকে ৫৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সিআইডির করা মামলার এজাহারে প্রতারণার ঘটনার বিশদ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।
যেভাবে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৫৪ লাখ টাকা
সিআইডির মামলায় বলা হয়, আক্তারুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে। গাজীপুরের আরেক ব্যবসায়ী হারুন অর রশীদের বোনের বাসায় ভাড়া থাকতেন আসামি শাহ আলী। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে শাড়ি ও লুঙ্গি এনে গাজীপুরে বিক্রি করতেন।
দুই বছর আগে শাহ আলী হারুনকে বলেন, সিরাজগঞ্জে তাঁর বন্ধু হাবিবুর রহমানের কাছে একটি কয়েন আছে। সেটি অনেক দামি। কয়েনটি হাবিবুর বিক্রি করবেন। শাহ আলীর কথায় আক্তারুজ্জামান ও হারুন কয়েনটি দেখতে চান।
পরে সিরাজগঞ্জে হাবিবুরের বাসায় যান আক্তারুজ্জামান ও হারুন। তবে হাবিবুর সেদিন তাঁদের কোনো কয়েন না দেখিয়ে বলেন, তাঁর কাছে কিছু চাল আছে। ওই চাল কয়েনটির সংস্পর্শে এসেছে। ফলে চালগুলোও এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও দামি। ওই চালের রাসায়নিক পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, কয়েনটি অনেক মূল্যবান।
২০২০ সালের জুলাইয়ে চালের রাসায়নিক পরীক্ষা করতে রাজধানীর মিরপুরে আসেন শাহ আলী ও হাবিবুর। সেদিন আক্তারুজ্জামান ও হারুনের সঙ্গে এস এম সেলিমুজ্জামান নামের এক ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দেন হাবিবুর। সেলিমুজ্জামান নিজেকে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। একই সঙ্গে তিনি মূল্যবান কয়েন বেচাকেনা করেন বলে জানান।
মিরপুরে সেলিমুজ্জামানের অফিসে চালের ‘রাসায়নিক পরীক্ষা’ হয়। পরে সেখানে থাকা কথিত রাসায়নিক পরীক্ষক হালিম তালুকদার ঘোষণা দেন, কয়েনটির সংস্পর্শে আসা চালগুলো দামি বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে। ফলে কয়েনটিও আসল বলে প্রমাণিত হয়েছে। তখন সেলিমুজ্জামান হাবিবুরের কাছে কয়েনটি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে হাবিবুরের কাছে থাকা কথিত কয়েনটি কিনতে চান আক্তারুজ্জামান। সেটির দাম নির্ধারণ হয় ১ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট সেলিমুজ্জামানের অফিসে হাবিবুরকে ২০ লাখ টাকার চেক দেন তিনি। পরে আরও নগদ ৩৪ লাখ টাকা দেন।
সিআইডি বলছে, কয়েনটি সংগ্রহের জন্য ২০২০ সালের নভেম্বরে আক্তারুজ্জামান সিরাজগঞ্জের হাবিবুরের এক ভগ্নিপতির বাসায় যান। সেদিন তিনি আরও ৫০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন হাবিবুরের হাতে। তবে কয়েন না দিয়ে একপর্যায়ে বাসার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান হাবিবুর ও শাহ আলী।
সিআইডি কর্মকর্তা মেহেদী মাকসুদ প্রথম আলোকে বলেন, হাবিবুর একজন পেশাদার প্রতারক। তাঁর বিরুদ্ধে আগেও প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে। তিনি তক্ষক বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অপর আসামি সেলিমও পেশাদার প্রতারক।