পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকেই দেখা যায় তারা জীবনের প্রকৃত মিশন বা উদ্দেশের প্রতি উদাসীন। তারা ‘সফলতার’ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বেহুঁশের মতো ভুল জিনিসের পেছনে ছোটেন।
দুনিয়ার জীবনে টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বড় বড় ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া, গুলশান-বনানীতে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানানো, প্রচুর পরিমাণে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, চরম বিলাসী জীবন যাপন করা এবং ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক দিয়ে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়াই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই জীবনের উদ্দেশ্য।
কিন্তু ইসলামে কি সফলতার ধারণা এরকম? মহাবিজ্ঞ, মহাজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দৃষ্টিতে সফলতার স্বরূপ একদমই ভিন্ন। তিনি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সফলতার ধারণা তুলে ধরেছেন যেন মানুষ সফলতার ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে এবং সঠিক কর্ম ধারা অবলম্বন করতে পারে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন,
اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ ﴿ۚۖ۶۲﴾ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ﴿ؕ۶۳﴾ لَهُمُ الۡبُشۡرٰی فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِکَلِمٰتِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿ؕ۶۴﴾
জেনে রেখ! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত। তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে আর আখেরাতেও। আল্লাহর কথার কোন হেরফের হয় না, এটাই হল বিরাট সাফল্য। [সুরা ইউনুসঃ ৬২-৬৪]
আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহর অলীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাদের প্রশংসা ও পরিচয় বর্ণনার সাথে সাথে তাদের প্রতি আখেরাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- যারা আল্লাহর অলী তাদের না থাকবে কোন অপছন্দনীয় বিষয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা, আর না থাকবে কোন উদ্দেশ্যে ব্যর্থতার গ্লানি। এদের জন্য পার্থিব জীবনেও সংবাদ রয়েছে এবং আখেরাতেও। দুনিয়াতেও তারা দুঃখ-ভয় থেকে মুক্ত। আর আখেরাতে তাদের মনে কোন চিন্তা-ভাবনা না থাকার অর্থ জান্নাতে যাওয়া। এতে সমস্ত জান্নাতবাসীই অন্তর্ভুক্ত।
আয়াতে উল্লেখিত ‘আওলিয়া’ শব্দটি অলী শব্দের বহুবচন। আরবী ভাষায় অলী অর্থ নিকটবর্তীও হয় এবং দোস্ত-বন্ধুও হয়। শরীআতের পরিভাষায় অলী বলতে বুঝায়ঃ যার মধ্যে দুটি গুণ আছেঃ ঈমান এবং তাকওয়া। মহান আল্লাহ বলেন, “জেনে রাখ! আল্লাহর অলী তথা বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা, যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।” [সূরা ইউনুসঃ ৬২–৬৩] যদি আল্লাহর অলী বলতে ঈমানদার ও মুত্তাকীদের বুঝায় তাহলে বান্দার ঈমান ও তাকওয়া অনুসারে আল্লাহর কাছে তার বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব নির্ধারিত হবে। সুতরাং যার ঈমান ও তাকওয়া সবচেয়ে বেশী পূর্ণ, তার বেলায়াত তথা আল্লাহর বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশী হবে। ফলে মানুষের মধ্যে তাদের ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহর বেলায়াতের মধ্যেও তারতম্য হবে।
قَدۡ اَفۡلَحَ مَنۡ زَکّٰىهَا ۪ۙ﴿۹﴾ وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ دَسّٰىهَا ﴿ؕ۱۰﴾
সেই সফলকাম হয়েছে যে নিজ আত্মাকে পবিত্র করেছে। সেই ব্যর্থ হয়েছে যে নিজ আত্মাকে কলূষিত করেছে। [সুরা শামসঃ ৯-১০]
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡهُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۹۰﴾
হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সুরা মায়িদাঃ ৯০]
فَاٰتِ ذَاالۡقُرۡبٰی حَقَّهٗ وَ الۡمِسۡکِیۡنَ وَ ابۡنَالسَّبِیۡلِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ یُرِیۡدُوۡنَ وَجۡهَ اللّٰهِ ۫ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۳۸﴾
কাজেই আত্মীয়দেরকে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য দিয়ে দাও আর অভাবগ্রস্ত এবং মুসাফিরদেরকেও। যারা আল্লাহর চেহারা (দর্শন) কামনা করে, এটা তাদের জন্য উত্তম, আর তারাই সফলকাম। [সুরা রুমঃ ৩৮]
قُلۡ لَّا یَسۡتَوِی الۡخَبِیۡثُ وَ الطَّیِّبُ وَ لَوۡ اَعۡجَبَکَ کَثۡرَۃُ الۡخَبِیۡثِ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰهَ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰۰﴾
বল, অপবিত্র আর পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্র বস্তুর প্রাচুর্য তোমাকে আকৃষ্ট করে। কাজেই হে জ্ঞানী সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। [সুরা মায়িদাঃ ১০০]
((الْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ) আরবী ভাষায় দুটি বিপরীত শব্দ। প্রত্যেক উৎকৃষ্ট বস্তুকে الطَّيِّب এবং প্রত্যেক নিকৃষ্ট বস্তুকে الْخَبِيث বলা হয়। অর্থাৎ কোন প্রকার خَبِيْث এর সাথেই কোন প্রকার طَيِّب এর তুলনা চলে না। আয়াতে خَبِيْث শব্দ দ্বারা হারাম ও অপবিত্র এবং طَيِّب শব্দ দ্বারা হালাল ও পবিত্র বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার দৃষ্টিতে, এমনকি প্রত্যেক সুস্থ্য বুদ্ধিমান লোকের দৃষ্টিতে, পবিত্র ও অপবিত্র এবং হালাল ও হারাম সমান হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে (الْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ) শব্দ দুটি স্বীয় ব্যাপকতার দিক দিয়ে হালাল ও হারাম অর্থ-সম্পদ, উত্তম ও অধম মানুষ এবং ভাল ও মন্দ কাজ-কর্ম ও চরিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাই কোন বিচারেই সৎ ও অসৎ এবং ভাল ও মন্দ সমান নয়। এ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহ তা’আলার কাছ থেকে হালাল ও হারাম কিংবা পবিত্র ও অপবিত্র বস্তু সমান নয়। ঈমান ও কুফর সমান নয়। জান্নাত ও জাহান্নাম সমান নয়। আনুগত্য ও অবাধ্যতা সমান নয়। সুন্নাতের অনুসারী ও বিদাআতের অনুসারী সমান নয়। [ইবন কাসীর, সা’দী, মুয়াসাসার]
যদিও মাঝে মাঝে মন্দ ও অনুৎকৃষ্ট বস্তুর প্রাচুর্য দর্শকদের বিস্মিত করে দেয় এবং আশ-পাশে মন্দ ও অপবিত্র বস্তুর ব্যাপক প্রসারের কারণে সেগুলোকেই ভাল মনে করতে থাকে, কিন্তু আসলে এটি মানুষের অবচেতন মনের একটি রোগ এবং অনুভূতির ক্রটি বিশেষ। মন্দ বস্তু কখনও ভাল হতে পারে না। সুতরাং উপকারী হালাল বস্তু স্বল্প হলেও তা অপকারী হারাম বস্তু বেশী হওয়ার চেয়ে উত্তম। [ফাতহুল কাদীর] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অল্প ও প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট জিনিস সেই অধিক জিনিস হতে উত্তম যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল ও উদাসীন রাখে। [মুসনাদে আহমাদ ৫/১৯৭]
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوا الرِّبٰۤوا اَضۡعَافًا مُّضٰعَفَۃً ۪ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۳۰﴾ۚ
হে মুমিনগণ! তোমরা সুদ খেও না ক্রমবর্ধিতভাবে, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। [সুরা আলে ইমরানঃ ১৩০]
আলোচ্য আয়াতে কয়েকগুণ বেশী অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধি হারকে সুদ হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। অন্যান্য আয়াতে অত্যন্ত কঠোরভাবে সর্বাবস্থায় সুদ হারাম হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। “আয়াতে চক্রবৃদ্ধি হারে” সুদ খাওয়া নিষেধ করার মধ্যে এদিকেও ইঙ্গিত হতে পারে যে, সুদ গ্রহণে অভ্যস্ত ব্যক্তি যদি চক্রবৃদ্ধি সুদ থেকে বেঁচেও থাকে, তবে সুদের উপার্জনকে যখন পুনরায় সুদে খাটাবে, তখন অবশ্যই দ্বিগুণের দ্বিগুণ হতে থাকবে- যদিও সুদখোরদের পরিভাষায় একে চক্রবৃদ্ধি সুদ বলা হবে না। সারকথা, সব সুদই পরিণামে দ্বিগুণের ওপর দ্বিগুন সুদ হয়ে থাকে।
সুতরাং আয়াতে সবরকম সুদকেই নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা ধ্বংসকারী সাতটি বিষয় হতে বেঁচে থাকবে, সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে বিষয়গুলো কি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শির্ক করা, জাদু করা, যথার্থ কারণ ছাড়া আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল ভক্ষন করা, যুদ্ধ অবস্থায় জেহাদের ময়দান হতে পলায়ণ করা, পবিত্র মুসলিম নারীর উপর ব্যাভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয়া।” [বুখারীঃ ২৭৬৬]
الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ۙ﴿۳﴾ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ ؕ﴿۴﴾ اُولٰٓئِکَ عَلٰی هُدًی مِّنۡ رَّبِّهِمۡ ٭ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵﴾
যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে। আর তোমার প্রতি যা নাযিল হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরকালের প্রতিও তারা নিশ্চিত বিশ্বাসী। তারাই তাদের প্রতিপালকের হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, আর তারাই সফলকাম। [সুরা বাকারাঃ ৩-৫]