ঈদের কেনাকাটার ভরা মৌসুমে পরপর দুই দিন দোকান খুলতে পারেননি ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার বিপণিবিতানগুলোর দোকানমালিকেরা। আর্থিক ক্ষতির মুখে তাঁরা গতকাল বুধবার ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা ও সহাবস্থান চেয়েছেন। ওদিকে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার, হামলাকারীদের বিচার ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যয় বহনসহ ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন। দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের কোনো মীমাংসা গত রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হয়নি।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এই যে আজ বৃহস্পতিবারও দোকানপাট খোলা যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণত বাড়তি কেনাবেচা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আগামীকাল ও পরশু ছুটির দিনে বেচাকেনা থেকেও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় আছেন দোকানমালিকেরা।
ছাত্রদের সঙ্গে দোকানমালিক ও কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হয়ে মারা যাওয়া নাহিদ হোসেনের (২০) পরিবারও কোনো মামলা করেনি। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁরা বিচার চান না। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রাতে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকালের পরিস্থিতি
ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউমার্কেট এলাকার দোকানমালিক ও কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় গত সোমবার রাতে। দুই খাবারের দোকানের দুই কর্মীর বিতণ্ডা থেকে এই ঘটনার সূত্রপাত। মঙ্গলবার দিনভর সংঘর্ষ চলে। গতকাল নতুন করে সংঘর্ষ হয়নি। সকালের ভাগে ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয়। সকাল থেকেই নিউমার্কেট এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। সড়কে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা অথবা দোকানমালিক ও কর্মীরা কেউ ছিলেন না। সায়েন্স ল্যাব থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত যান চলাচল করেছে স্বাভাবিকভাবেই।
দুপুর ১২টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে কিছু দোকান খোলা দেখা যায়। তবে ক্রেতার উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। বেলা দুইটার দিকে ঢাকা কলেজের সামনের বিপণিবিতানগুলোতে এক-দুটি করে দোকান খুলতে শুরু করে। বেলা তিনটার দিকে গাউছিয়া মার্কেটের কয়েকটি দোকান খোলা হয়। একে একে যখন দোকান খুলছিল, তখন বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা রাস্তায় নামেন। কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ সময় চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনে কিছু মানুষ ছিলেন। তাঁদের ধাওয়া দেন ছাত্ররা। এতে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। শিক্ষকেরা এসে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে তাঁদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেন।
এর আগে বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বিক্ষোভ করে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে তাঁরা চলে যান।
ব্যবসায়ীদের সাদা পতাকা
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি গতকাল বেলা দুইটায় নিজেদের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে। এতে সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা চান। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চান। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা তাঁরা চান না। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে দোকানমালিক, স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাবও দেন তিনি।
আমিনুল ইসলাম দাবি করেন, দুই দিনের হামলা ও সংঘর্ষে কোনো ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন না। ঘটনার সঙ্গে তৃতীয় পক্ষ জড়িত। তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউমার্কেট এলাকার বিপণিবিতানের দোকানমালিক ও কর্মীদের উদ্দেশে সমিতির সভাপতি আরও বলেন, কেউ যেন শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য না দেন। তিনি শিক্ষার্থীদেরও সহনশীল আচরণ করার অনুরোধ করেন।
এদিকে দুপুরের পর নিউমার্কেট এলাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে শান্তির প্রতীক সাদা পতাকা উড়তে দেখা যায়।
দেওয়ান আমিনুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, তাঁরা সন্ধ্যায় দোকান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় তা সম্ভব হয়নি।
এদিকে গতকাল বিকেলে দোকানমালিক ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে বৈঠক হবে বলে একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন ও বাংলাদেশ
দোকানমালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা দুজন বৈঠকের বিষয়ে ফোনালাপ করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি।
ছাত্রদের ১০ দফা দাবি
ঢাকা কলেজের ছাত্ররা গতকাল রাত সাড়ে ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনে ১০ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সাজ্জাদুর রহমান, অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদ ও নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ূমকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং কলেজ প্রশাসনের কাছে পুলিশকে ক্ষমা চাইতে হবে। শিক্ষার্থী ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলাকারীদের বিচার করতে হবে। হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার খরচ দোকান মালিক সমিতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বহন করতে হবে। নিহত নাহিদ হোসেনের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রতিটি বিপণিবিতান ও দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত, অবৈধ কার পার্কিং উচ্ছেদ ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি বিপণিবিতানের কর্মীদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্রেতাদের হেনস্তা ও নারীদের যৌন হয়রানি বন্ধে একটি বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।
চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট ও নিউমার্কেটের মধ্যে ঢাকা কলেজের যে জমি আছে, তার ইজারা বাতিল করতে হবে।
ঢাকা কলেজের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের উপস্থিতিতে দাবিগুলো তুলে ধরেন ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী সুজয় বালা।
সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকা কলেজ ও কলেজের ছাত্রাবাস গত মঙ্গলবার বন্ধ ঘোষণা করা হলেও ছাত্ররা তা মানেননি। ছাত্রাবাস খালি করা হয়নি। তাঁদের ভাষ্য, যেকোনো মূল্যে তাঁরা ছাত্রাবাস ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন।
সাধারণ দোকানিরা দুশ্চিন্তায়
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দাবি, নিউমার্কেট এলাকার সড়কগুলোকে কেন্দ্র করে ৩৪টি ছোট-বড় বিপণিবিতানে ১২ থেকে ১৪ হাজার দোকান রয়েছে। এসব দোকানে ঈদের মৌসুমে দিনে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। সাধারণ দোকানমালিকেরা বলেছেন, করোনার কারণে দুই বছর ঈদে তাঁরা তেমন কোনো বেচাকেনা করতে পারেননি। ছোট অনেক দোকানের মালিক ঋণে জর্জরিত। এবার যেহেতু করোনার প্রাদুর্ভাব কমেছে, সেহেতু তাঁরা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু দুই দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।
নিউমার্কেট এলাকার নূর মার্কেটের শিশুদের পোশাকের দোকান সায়েম ফ্যাশনের মালিক সায়েম হোসেন বলেন, ক্রেতারা আতঙ্কিত। দোকান খুললেও বিক্রি আগের মতো হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।