তিনি হলেন নাসির বিন হামাদ বিন হুমাইন আল-ফাহদ, আসাইদাহ থেকে ফারহেদ থেকে, উতায়বাহ থেকে আল-রাওয়াকাহ থেকে, যার পূর্বপুরুষরা আদনান থেকে বনী সাদ বিন বকর বিন হাওয়াযিন গোত্রের সাথে মিলিত হয়। এ গোত্রের অধিবাসীরাই রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লালনপালন করেছিল। তার মায়ের নাম নুরা আল-গাজিয়া এবং তার বংশ আদ-দাওয়াসির গোত্রে ফিরে যায়।
তার পরিবার বসবাস করত আল-সুওয়াইরে। এটি আল-জুলফি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার পিতা শায়খ হামাদ ইবনে হুমায়ীন শায়খ আল-আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম রাহ.-এর সাথে কাজ করার জন্য রিয়াদে চলে আসেন। তাই তিনিও বাবার সাথে চলে যান এবং তিনি মারা যাওয়া পর্যন্ত তাঁর সাথে ১৮ বছর থাকেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
তিনি ১৩৮৮ সালের শাওয়াল মাসে রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আল-মালিক সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি এখানে অভূতপূর্ব ফলাফল লাভ করেন এবং তিনি ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষ পড়ার সময় তিনি এখান থেকে ইস্তফা নেন। এরপর সেখান থেকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সাউদের শরিয়া কলেজে স্থানান্তরিত হন। তিনি ২৪ বছর বয়সে মাত্র ৩ মাসে পুরো কুরআন হিফজ করেন। তিনি যে মুসহাফ থেকে হিফজ করেন সেটির প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেনঃ
এটির (কুরআনের) হিফজ সম্পন্ন হল, সকল প্রশংসা আল্লাহর ও সফলতা তাঁর সাহায্যেই নিহিত। মুসতাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের হিজরির ২৯/১১/১৪১২-র রোববারের আসরে হিফজ শেষ হল। শুরু হয়েছিল একই বছরের রামাদানে। সকল প্রশংসা আল্লাহর যার কল্যাণে এ মহৎ অর্জন সম্ভব হয়েছে।
তাঁর শিক্ষকগণ ও পড়াশোনা
তিনি কলেজে একদল শিক্ষকের অধীনে অধ্যয়ন করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছেনঃ
শায়খ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল্লাহ আর-রাজিহি
শায়খ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল্লাহ আল-আশ-শাইখ
শাইখ সালিহ আল-আতরাম
শায়খ আবদুল্লাহ আর-রুকবান
শায়খ যায়েদ বিন ফায়াদ রাহ.
শায়খ আহমদ মাবাদ
এবং আরও অনেকে।
তিনি ১৪১২ হিজরিতে ক্লাসে প্রথম হয়ে কলেজ থেকে ইজাজাহ লাভ করেন। তাঁকে পুনরায় শরিয়া কলেজ ও উসুলুল দীন অধ্যয়নের জন্য অনুরোধ করা হয়। তিনি উসুলুল দীন নির্বাচন করেন। তাঁকে থাইল্যান্ডে উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে তিনি এক জাহমির সাথে বিতর্ক করেন ও তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। শ্রোতারা তাঁর প্রশংসা করেন।
তিনি গ্রন্থ সংগ্রহ, অধ্যয়ন ও গবেষণার পেছনে সময় ব্যয় করেন। তিনি পড়তে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর পুত্র (মুসআব ইবনু নাসির আল-ফাহদ) বলেন, “আমি তাঁকে বাসায় কখনো একটা ঘন্টাও বই ছাড়া দেখিনি, তিনি গাড়িতে ওঠার সময় বই নিয়ে যেতেন এবং ট্রাফিক লাইটের আলোয় পড়তেন। আমি যদি বলি তিনি দিনে ১৫ ঘন্টা পড়েন, তবুও তাঁর ওপর মারাত্মক অবিচার করা হবে।”
তিনি শরিয়ার নানা বিভাগ যেমন আকিদা ও এর সম্পর্কিত বিষয়াদি, হাদিস, রিজাল, সকল মাজহাবের ফিকহ, উসুলুল ফিকহ ও ফারাইদে (উত্তরাধিকার) শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন এবং নিজেকে অতুলনীয় প্রমাণ করেছেন। শরিয়তের বিধান বের করে আনার ও চূড়ান্ত মতামত দেয়ার ব্যতিক্রমী দক্ষতা আছে তাঁর।
তিনি ইতিহাস ও বংশতত্ত্বের একজন পণ্ডিতও বটে। একবার শায়খ ওয়ালিদ আল-সিনানীকে কিছু বংশবৃত্তান্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় যেহেতু তিনি বংশতালিকায় অতুলনীয় এক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আস’আদীকে জিজ্ঞাসা করুন।” অর্থাৎ, শায়খ নাসির আল-ফাহদকে।
উনার ছেলে বলেন, “ইমাম (মুহাম্মদ ইবনে সাউদ) বিশ্ববিদ্যালয়ের আকিদার কিছু অধ্যাপক আমাকে বলেছেনঃ ‘তোমার বাবা আমার সহপাঠী (মাস্টার্সের) ছিলেন। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিলেন তিনি। খুব দ্রুত বুঝতে ও মুখস্থ করতে পারতেন। তার কঠোরতা ব্যতীত সমালোচনা করার মতো কিছু নেই।’ ”
তিনি আরও বলেন, “আমি শুনেছি যে আকিদা বিভাগের এক উস্তাদ একদিন তার ছাত্রদের বলেছিলেন: “আমাদের ডিপার্টমেন্টে একজনের নানা ভুল ধারণা ছিল। কিন্তু নাসির আল-ফাহদ ছাড়া কেউই তার মুখোমুখী হতে পারত না।”
তাঁর লেখনী
তিনি অসংখ্য গ্রন্থ ও নিবন্ধ রচনা করেছেন। যেমনঃ
- ব্যাকরণ ও গঠনে শায়খুল ইসলামের পছন্দ ও অভিমত (মুদ্রিত)
- আল-ইতিসাম (গ্রন্থ)-এর বিরোধীদের প্রতি বার্তা (মুদ্রিত)
- মূর্তি ভাঙ্গার বাধ্যবাধকতার দলিল
- যারা আমেরিকানদের সহায়তা করে তাদের কুফরের প্রমাণ
খণ্ড একঃ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান
- যারা আমেরিকানদের সহায়তা করে তাদের কুফরের প্রমাণ
খণ্ড দুইঃ ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযান
- মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠার বিপদ স্পষ্টকরণ
- হাততালি দেওয়ার বিধান নিরূপণ
- ইবনু হাজম আয যাহিরির মতে জারহ ওয়াত তাদিল
- অ্যালকোহলযুক্ত সুগন্ধির বিধান
- সুর করে কুরআন তিলাওয়াতের বিধান
- ইমামের পেছনে মুসাফিরের সালাত সংক্ষিপ্ত করার বিধান
- রাফিজাদের বিরুদ্ধে কঠোরতা জায়িজ হওয়া স্পষ্টীকরণ
- শায়খ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল-আশ-শাইখ রাহ. এর জীবনী (মুদ্রিত)
- মাজমুউল ফাতাওয়াকে ভুল ছাপা ও টাইপোগ্রাফিক ত্রুটি থেকে রক্ষা করা (মুদ্রিত)
- ইসলামি ভিডিও ও এর ‘ইসলামি বিকল্প’ (মুদ্রিত)
- গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের বৈধতা
- হাসান আল-মালিকির সংশয়ের খণ্ডন
- অন্য নারীর সামনে নারীর পোশাক কেমন হবে
- আল-কারজাভির বাতিল মতের সারসংক্ষেপ
এ ছাড়া তিনি আরও অনেক উপকারী রচনা ও গ্রন্থ লিখেছেন।
কারাবাস ও বিচার
তিনি ১৪১৫ হিজরিতে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে আল-হাইর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি সাড়ে তিন বছর ছিলেন। ১৪১৮ হিজরিতে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ইন্টারনেটে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে সময় স্বল্পতার কারণে তিনি ইন্টারনেটবিমুখ হয়ে যান। তাঁর কাছে আগত মানুষদের সংখ্যা বাড়ছিল। সবার জন্য আলাদাভাবে তিনি সময় করতে পারছিলেন না। তাই তিনি প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে তিনি তার বাড়িতে জমায়েতের আয়োজন করতেন। সেখানে হাদিস ও বর্ণনা নিয়ে আলোচনা হতো। পরবর্তীতে আগতদের উপস্থিতি এত বেড়ে যায় যে ঘরে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত। তাই তাদেরকে ঘরের ঠিক মাঝখানে শায়খের পাশে আরেকটি লাইন করতে হত।
আফগানিস্তানের সাথে আমেরিকার যুদ্ধ দ্বারা আল্লাহ যখন মুসলিমদের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন, তখন শায়খ মুমিনদের তাঁদের বিশ্বাসী ভাইদের সমর্থন দিতে ও সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেয়ে কুফফারদের সাথে মিত্রতা গড়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েননি। ফলে সৌদি তাগুত সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৪২৪ সালে তাঁকে কারাবাসে পাঠানো হয়। তখন থেকে শায়খ নির্জন কারাবাসে আছেন। তাঁকে তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে দেয়া হয় না।
কারাবাসজীবন তাঁর জন্য আল্লাহর ইচ্ছায় রহমত হয়ে ওঠে। সেখানে তাঁর ইলমের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। সেখানে তিনি নয়টি হাদিস গ্রন্থের হিফজ সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া অনেকগুলো বই ও মতন মুখস্থ করেন। তিনি মাজমুউল ফাতাওয়া ছয় বার পড়েছেন এবং ৮৫টি নিবন্ধ রচনা করেছেন। এ ছাড়া, তিনি শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়ার উসুলুল ফিকর ও উসুলুল তাফসিরকে কবিতায় রূপান্তরিত করেন যা ছিল ৮০০ লাইনের অধিক।
সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক ভাই বলেছেন: সেখানকার কিছু সৈন্য শায়খ নাসিরের ব্যাপারে বলে, ‘এই লোকটার ব্যাপারটা কি? সারাদিনে ৪ ঘন্টা ঘুমায় আর বাকি সময় পড়াশোনা আর সালাত আদায় করে কাটায়?’
কারাগারের অবস্থা
শায়খ নাসির আল-ফাহদকে সৌদি সরকার কারাগারে চরম প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন করে। তাঁকে নির্জন কারাবাস, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, অন্যান্য বন্দীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তাঁর সাথে অপমানজনক কাজ করা হয়। যে ব্যক্তি কুতুবুত তিসাহ (হাদিসের নয়টি কিতাব: বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী ইত্যাদি) মুখস্থ করেছেন, তিনি কি এমন আচরণ পাওয়ার যোগ্য?
আলিমদের তাঁর প্রশংসা
আল-আল্লামা হামুদ বিন উকলা আশ শুয়াইবী রাহ. শায়খ ফাহদের ‘আমেরিকানদের সহায়তাকারীর কুফরের প্রমাণ’ গ্রন্থটির প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, “শায়খ নাসির আল-ফাহদ, আল্লাহ তাকে সফলতা দান করুন, অসংখ্য বরকতময় কাজের অংশীদার তিনি। তিনি সত্য ও এর অনুসারীদের বিজয়ী করতে এবং বাতিল ও তার অনুসারীদের প্রতিহত করতে সরাসরি অংশ নিয়েছেন এবং আপন সময় ব্যয় করেছেন। নানা বই ও প্রবন্ধে তিনি তাদের মোকাবিলা করেছেন। আল্লাহ যেন তাঁকে উত্তম প্রতিদান দেন এবং তাঁকে হকের পথে অটল রাখেন আমরা এ প্রার্থনা করি।”
আশ-শুয়াইবীর পুত্র বলেন, “আমাকে কিছু দীনি ভাই বলেছেনঃ ‘যখন দীনি ভাইয়েরা শায়খ হামুদ আশ-শুয়াইবীর কাছে নানা ভ্রান্তি ও অপব্যাখ্যার ব্যাপারে প্রশ্ন নিয়ে আসতেন তখন তিনি জবাব দিতেনঃ শায়খ নাসির কি এর জবাব দিয়েছেন?”
শায়খুল মুহাদ্দিস সুলাইমান ইবনু নাসির আল উলওয়ান একই জায়গায় (‘আমেরিকানদের সহায়তাকারীর কুফরের প্রমাণ’) বলেন, “আল্লাহকে শায়খকে শক্তিদান করুন। যে হাতে তিনি গ্রন্থটি রচনা করেছেন তা কতইনা অসাধারণ! আহলুল ইলম ও সত্যের সন্ধানীদের কাছে এটি প্রশংসিত হওয়ার দাবিদার। এটি সেই গ্রন্থ যেখানে হিদায়াতের পথিক ইমাম এবং আহলুল ইলম ও তাকওয়াবানদের অনুসৃত আকিদা ও ফিকহকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “তিনি মুখস্থবিদ্যায় অত্যন্ত দক্ষ। নানা শাস্ত্রে তাঁর প্রচুর ইলম আছে। কারাগারে তাঁর ওপর ব্যাপক জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়।”
শায়খুল মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ আস-সাদ বলেন, “আমি শায়খ নাসির আল-ফাহদ রচিত অন্যান্য রচনা দেখেছি। সবগুলোই ছিল কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত ও অত্যন্ত ফায়দাজনক। তিনি সালফে-সালিহিনদের পথরেখা ও পদ্ধতি অনুসরণ করেন। আমরা তাঁকে এমনটাই পেয়েছি। প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহই সু-অবগত।”
মহান আল্লাহ শায়খকে হিফাজত করুন, জালিমের কারাগার থেকে তাঁকে মুক্ত করুন এবং মুসলিমদের তাঁর ইলম থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দিন।
– আত-তিবইয়ান পাবলিকেশন্স দ্বারা রচিত একটি জীবনী এবং তার পুত্র মুসআব ইবনু নাসির আল-ফাহদ (আল্লাহ তাদের উভয়ের মুক্তি ত্বরান্বিত করুন) রচিত জীবনী থেকে সংগৃহীত ও অনূদিত।