বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের দাবির বিষয়ে বাংলাদেশ ১ মার্চ জাতিসংঘে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশ আশা করছে, এই দাবির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর সালিসি আদালতের রায় অনুসরণ করেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য লিমিটস অব দ্য কন্টিনেন্টাল শেলফে (সিএলসিএস) মহীসোপানের দাবির বিষয়ে তথ্য তুলে ধরল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর জন্য মহীসোপানের দাবি উপস্থাপনের জন্য বেশ কয়েকটি বিকল্প পথ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে উপকূলীয় একটি ভিত্তিরেখা বা বেসলাইন থেকে ৩৫০ নৌ মাইল পর্যন্ত নিজেদের দাবি করে উপস্থাপন। আরেকটি হচ্ছে, আড়াই হাজার আইসোবাথ (সমগভীরতা রেখা) ও ১০০ নৌ মাইল। নিজের মহীসোপান নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিকল্পটি উপস্থাপন করেছে।
১ মার্চ জাতিসংঘে মহীসোপানের দাবির পক্ষে হালনাগাদ বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপনের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আশা প্রকাশ করেন, নতুন করে তথ্য উপস্থাপনের পর বাংলাদেশের সম্পদ আহরণের বিষয়টির সুরাহা হবে।২০২০ সালের ২২ অক্টোবর সিএলসিএসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মহীসোপানের সংশোধিত তথ্য দাখিল করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমার এবং পরের এপ্রিলে ভারত বাংলাদেশের ওই দাবির বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে জাতিসংঘের কাছে চিঠি দেয়।
ভারত জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের যে ভিত্তিরেখার ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহীসোপান নির্ধারণ করেছে, তা ভারতের মহীসোপানের একটি অংশ। তাই ভারত জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণবিষয়ক কমিশনে বাংলাদেশের দাবিকে বিবেচনায় না নেওয়ার অনুরোধ জানায়। অন্যদিকে মিয়ানমার জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানায়, বাংলাদেশ যে ভিত্তিরেখা দেখিয়েছে, তা আদালতের দেওয়া রায়ের পরিপন্থী। কাজেই বাংলাদেশের দাবি যেন বিবেচনায় নেওয়া না হয়।
এরপর বাংলাদেশ গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিজের দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। আর ১ মার্চ এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য হালনাগাদ করা হলো।
উল্লেখ্য, সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর ভূখণ্ডের যে অংশ সমুদ্রের দিকে পানির নিচে ঢালু হয়ে নেমে যায়, তাকে মহীসোপান বলে। সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন বা ভিত্তিরেখা থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের সাড়ে তিন শ মাইল এলাকাকে সংশ্লিষ্ট দেশের মহীসোপান হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। সেখানে অন্য কোনো দেশ মাছ ধরতে পারে না এবং খনিজ সম্পদের দাবি করতে পারে না। এই ২০০ মাইলের পর ১৫০ মাইল পর্যন্ত সীমায় সমুদ্রের তলদেশে খনিজ সম্পদের মালিক ওই দেশ, তবে ওই এলাকায় মাছ ধরতে পারে সব দেশ।
বাংলাদেশের দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে লেখা চিঠিতে ভিত্তিরেখার পাশাপাশি গ্রে এরিয়া বা আপাত অস্পষ্ট রেখা নিয়েও উল্লেখ করেছে।এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেন, গ্রে এরিয়ার বিষয়টি সালিসি আদালতের কারণে এসেছে। দুই দেশ যখন গ্রে এরিয়ার বিষয়ে আদালতের রায় মেনে নিয়েছে, তাই এ বিষয় নিয়ে নতুন করে আলোচনার সুযোগ সিএলসিএসে নেই। তা ছাড়া মহীসোপান হচ্ছে সাগরের তলদেশের মাটি এবং অন্তঃস্থ মৃত্তিকা। আর গ্রে এরিয়া মানে হচ্ছে পানির অংশ। ফলে পানির সঙ্গে মহীসোপান নির্ধারণের কোনো সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশের দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০০৮ সালে মহীসোপান বিষয়ে তাদের দাবি উপস্থাপন করে। আর বাংলাদেশ একই বিষয়ে নিজের দাবি তুলে ধরে ২০১১ সালে। ওই সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুই দেশ নিজেদের ভিত্তিরেখায় বাংলাদেশের অংশকে নিজেদের বলে দেখায়। যদিও দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধের নিষ্পত্তি তখন পর্যন্ত হয়নি। ২০১৪ সালে দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এরপর প্রায় ছয় বছরের অপেক্ষা শেষে আদালতের রায় মেনে জাতিসংঘের কমিশনে মহীসোপানের সংশোধিত দাবি উপস্থাপন করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ মনে করছে, আদালতের রায়ের অনুসরণে তৈরি করা বাংলাদেশের দাবি বিবেচনায় নিয়ে সিএলসিএস বিষয়টি সুরাহার জন্য উপকমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত দেবে।একটি দেশের মহীসোপান নির্ধারণের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত করার আগে জাতিসংঘের সিএলসিএসের সুপারিশ অপরিহার্য। মহীসোপানের সুরাহা হওয়ার পর নিজের সমুদ্র এলাকায় জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর একটি দেশের কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়। তবে মহীসোপানে তেল, গ্যাসসহ খনিজের একটি অংশ জাতিসংঘকে দিতে হয়।
জাতিসংঘের সমুদ্র আইনবিষয়ক সনদ অনুযায়ী, প্রথম পাঁচ বছর এ সম্পদ আহরণের সময় জাতিসংঘকে কিছু দিতে হয় না। তবে পরবর্তী সাত বছর সম্পদ আহরণের ৭ শতাংশ অর্থ মূল্যে কিংবা সরাসরি ওই প্রাকৃতিক সম্পদ জাতিসংঘকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অবশ্য উন্নয়নশীল কোনো দেশ যদি সমুদ্রের তলদেশ থেকে যে সম্পদ আহরণ করে, সেটি তার কাছে পর্যাপ্ত না থাকে, তাহলে জাতিসংঘকে ভাগ দিতে হয় না।