তনুকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।তাই আয়নার সামনে বসে রেডি হয়ে নিচ্ছে সে।পুরো সকাল পাত্রপক্ষের জন্য নানারকম রান্না করে কেটেছে।কারণ মা বলেছেন বিয়ের কথা চলাকালীন এসব টুকটাক গুন দেখাতে পারলে কাজ তাড়াতাড়ি এগোয়।
তনু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে;থার্ড ইয়ার।তনুর ছোট ভাই টুটুল ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।তনুটা যেমন চুপচাপ,টুটুল তেমন চঞ্চল।ছোট বড় মানেনা।উচিৎ কথা শোনাতে পটু।বাবা আজকে কঠোরভাবে টুটুলকে বলে দিয়েছেন যেন বেশি কথা না বলে।পাত্রপক্ষ অসন্তুষ্ট হলে বিয়ের কথা এগোবেনা।টুটুলের অবশ্য কোনো গ্যারান্টি নেই।মা সেই কথা জানেন।তাই তার মেয়েকে ছেলের পছন্দ হবে কিনা,টুটুল আবার কোনো গন্ডগোল করে ফেলবে কিনা এসব নিয়ে তিনি সকাল থেকে বেশ ভীত।
পাত্রপক্ষ চলে এসেছে।টুটুল আর বাবা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে বসার ঘরে এনে বসিয়েছেন।তাদের অবস্থা খুব একটা হাইফাই না হলেও আজ বসার ঘরটা নিজেদের সাধ্যমত সাজিয়েছে।পাত্রের মা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখছেন।ভাড়াটেরা বাড়ি ভাড়া নিতে এলে ঘরের কোণাগুলো যেমন খুঁটে খুঁটে দেখে,ইনিও দেখছেন ঠিক সেভাবেই।এনার দেখা দেখে টুটুল হেসে দিলো।বাবার চোখে চোখ পড়তেই থেমে যেতে হলো।পরিস্থিতি সামলাতে বাবা বললেন:
-আপনাদের আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
-না।রাস্তায় তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি।তবে আপনাদের গলিটা বড় সরু।গাড়ি ঢোকেনা,না?
-ইয়ে মানে…
-থাক।পাত্রীকে ডাকুন।আমার সুমন বড় ব্যস্ত মানুষ।অফিসের বস তো ওকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা।সব কাজের ভার ওর।তাই পাত্রী দেখার পেছনে ঘন্টার পর ঘন্টা অপচয় করার মত সময় ওর হাতে নেই।
পাত্রের মায়ের তাড়ায় তনুর মা তনুকে আনতে গেল।
এর মাঝে সুমনের মা টুটুলের সাথে কথা বলে নিল:
-কোন ক্লাসে পড়ো?
-ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।
-ও বাবা!দেখে তো মনেই হয়না!
-অনেককে দেখেই তো অনেককিছু মনে হয়না।কিন্তু কি আর করা যাবে!মেনে নিতে হয়,তাইনা?
অনেকরকম খাবার নিয়ে তনু ও তনুর মা ঘরে ঢুকল।তনুর মাথায় ঘোমটা।
প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে সুমনের মা তনুকে বললেন:
-তা তোমার পছন্দ অপছন্দ কি কি?
(তনু চুপ)
-থাক,বলতে হবে না।ওসব শোনা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়।আমি শুধু জানিয়ে দিতে চাই যে, বিয়ের পর কিন্তু তোমার শখ আহ্লাদ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না মেয়ে।আমার বাড়ির বউ হলে আমার দিকটা দেখেশুনে চলতে হবে তোমার,বুঝতে পেরেছো তো?
-তাহলে তো দেখছি আমাদেরকেই আপনাকে জেরা করতে বসতে হয়।না মানে আপনার কি পছন্দ,কি অপছন্দ সেসব জানা যেত তাহলে।
টুটুলের কথায় বাবা বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালেন।
সুমনের মা অবশ্য কথাটায় পাত্তা দিলেন না।তবে টুটুলকে শোনানোর জন্য তনুর বাবাকে বললেন:
-বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই তো মেয়েদের আসলা বাড়ি,না কি?শাশুড়িই তখন তার কারিগর।শাশুড়িই তো বউমাকে ভেঙ্গে চুড়ে আবার নতুন করে গড়ে তুলবে তার সংসারের যোগ্য বউ করার জন্য।
-হ্যাঁ,তাই তো..
তনুর বাবা শুকনো মুখে বললেন।
-আরে শাশুড়িরা যেই সংসারে এত বছর ধরে আছে,সেই সংসারের জন্য কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা তো তারাই সবচেয়ে ভালো বুঝবে।তাই বউমাদের শাশুড়ির কথা মেনে চলা উচিত।তারা যা বলবে তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত।তবেই না সে যোগ্য বউ!
টুটুল প্রশ্ন করলো:
-আর যদি শাশুড়ির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে না পারে?
-তবে সে মেয়ের সংসার করার দরকার নেই।বাপের বাড়ি এসে বসে থাকাই ভালো।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ সুমনের মায়ের ফোন বেজে উঠলো।সুমনের বড় বোন ফোন দিয়েছে।
-আমার মেয়ের ফোন,বুঝলেন? ঢাকায় থাকে।জামাইয়ের চাকরি তো ঢাকায়।অনেক বড় অফিসার।অনেক বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছি মেয়েটার।জামাইয়ের প্রমোশন হওয়ার কথা।নিশ্চই প্রমোশনের খবর জানাতে কল দিয়েছে।দেখি লাউডস্পিকারে দেই।
কল রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিলেন উনি।সুমনের বড় বোন কাঁদছে।
-মা, আমার শাশুড়ির সাথে আজকে আমার ঝগড়া হয়েছে।উনি বলেন আমি রোজ দেরী করে উঠি বলে সংসারের কাজকর্ম ঠিকঠাক হয়না। কাজের লোকের কাজ ওনার পছন্দ না।তাই আমাকে কালকে থেকে সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে তোমার জামাইয়ের জন্য নাস্তা বানাতে বলেছে।
-এত সকালে ওঠার তো তোর অভ্যাস নেই।
-হ্যাঁ,এত সকালে আমি উঠতে পারব না।শাশুড়ির সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে নাকি?পারবনা আমি ওনার সব কথা শুনতে।আমি তো ওনার দাসী না।
সুমনের মা মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কিছু বলতে যাবে এমন সময় টুটুল বলে উঠলো:
-যে মেয়ে শাশুড়ির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে না পারে সে মেয়ের সংসার করার দরকার নেই।বাপের বাড়ি এসে বসে থাকাই ভালো।
সুমনের মা টুটুলের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো।
টুটুল তখন বললো,”এটা আমার কথা না,আন্টি।একটু আগেই কোথায় যেন শুনলাম কথাটা”।
সুমনের মা ফোন নামিয়ে বসে রইলেন।কিছু বলছেন না।হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন।
©দীপা সিকদার জ্যোতি