সিপাহি বিদ্রোহ বা সৈনিক বিদ্রোহ ১৮৫৭ সালের ১০ মে অধুনা পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সিপাহিদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ। ক্রমশ এই বিদ্রোহ গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহটি ১৮৫৭ সালে দমানোর পর ব্রিটিশরা বুঝতে পারল যে তাদেরকে নিজেদের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। তারা যেভাবে ভারতকে শাসন করছে এভাবে আর করা যাবে না। অর্থাৎ, বর্ণবাদী ও বৈষম্যবাদী হওয়া যাবে না, ভারতীয়দের সকল সরকারী অবস্থান থেকে বঞ্চিত রাখা যাবে না। তাই তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে লাগল। কিন্তু এরপরও মুসলিমরা তখনও প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসেবেই ছিল। আমি এটা বানিয়ে বলছি না, পক্ষপাতিত্ত্বও করছি না। এই বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের পর মুসলিম সম্প্রদায় ভারতের ঔপনিবেশিক শক্তির ক্রোধের মুখোমুখি হয়। এই বিষয়টি একজন ব্রিটিশ নিজে তার বইয়ে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বইটি লেখেন ১৮৭১ সালে। বইটির শিরোনামেই অদ্ভুত বিষয় লুকিয়ে আছে। শিরোনাম ছিল “ভারতীয় মুসলমানরা: তারা কি সচেতনভাবে রাণীর বিদ্রোহ করছে?” (The Indian Musalmans: Are They Bound in Conscience to Rebel Against the Queen?)। লেখকের নাম উইলিয়াম উইলসন হান্টার।
তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য, উপনিবেশবাদীদের একজন। তিনি তার বইটিতে বলেছিলেন যে, মুসলিমরা যেন তাদের বিবেকের তাড়নায় বা সচেতনভাবে রাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বদ্ধপরিকর। এর পেছনে তিনি কিছু কারণও উল্লেখ করেন। তিনি উদাহরণ হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরোধের কথা তুলে ধরেন। তিনি আবিতাবাদের পাহাড় এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের কথা বলেন যেখানে মুসলমানরা সেখানকার কিছু শহরে জড়ো হয় এবং তারা সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর অবিরাম আক্রমণ চালায়। অর্থাৎ তিনি প্রথমে মুসলিমদের এসব কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। ধরে যেন বুঝাতে চেয়েছেন যে, দেখুন এরা এসব করছে কারণ এরা কোনো একটা মতাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ। তিনি এটাকে ওয়াহাবি মতামর্শ বলেন। মূলত ওয়াহাবি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। যারা বর্তমানে ওয়াহাবি শব্দটি ব্যবহার করেন তারা জেনে রাখুন যে, আপনারা যে শব্দটি ব্যবহার করছেন তার উৎপত্তি হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাতে। ওয়াহাবি শব্দটি দিয়ে এমন বিদ্রোহীদের বোঝানো হতো যারা ভারতে ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে চাইত না। তাদেরকেই ওয়াহাবি বলা হতো। আপনি এই বিষয়গুলো উল্লিখিত বইটিতে খুঁজে পাবেন।
তিনি বলতে চেয়েছেন যে, মুসলিমরা প্রান্তিক গোষ্ঠী, তারা একটা সমস্যা। এর পেছনে তিনি কিছু কারণ উল্লেখ করেন। এরপর সেগুলোর সমাধানও তিনি দেন। তার সমাধানটা ছিল, মুসলিমদেরকে আমাদের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলা। কারণ এটা না করলে তারা আরো প্রান্তিক হয়ে পড়বে, আরো দূরে সরে যাবে, আমাদের জন্য আরো সমস্যা তৈরী করবে। অর্থাৎ এই ব্যাপারে ব্রিটিশ ত্বরিৎ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এই বইটির জবাবে আরেকটি বই লেখেন সাইয়েদ আহমদ খান। তিনি ছিলেন দিল্লির এক মুসলিম বুদ্ধিজীবী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কি ঘটছে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের পুরোপুরি দায়ী করা হয়। ১৮৫৭-এর এই স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিমদের দায়ী করা হলেও এতে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। কিন্তু সব দায়ভার, সব ক্ষোভ চাপানো হয় মুসলিমদের ওপর। এমনকি এটাকে বলা হয় মোহাম্মদীয় বিদ্রোহ।
এরপর যা ঘটে – মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম সমাজের ভেতর ক্ষয়িষ্ণুতার নিদর্শন দেখতে শুরু করেন। মুসলিমদের পদ্ধতিগতভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আসন গ্রহণ থেকে বিরত করা হয়তে থাকে। সরকার পরিকল্পনা ও নীতিগতভাবে মুসলিমদের বঞ্চিত করতে থাকে। তাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়, যে কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হতে থাকে। অন্যদিকে হিন্দুদের উচ্চপদ দেওয়া হতে থাকে। এগুলোরও ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে।
তৎকালীন মুসলিমরা ফারসই, আরবি, উরদু ইত্যাদি জানত। কিন্তু তারা ইংরেজি ভাষা জানত না এবং জানত না কীভাবে ব্রিটিশ শাসকদের সাথে বনিবনা করবে, তাই তাদের অবস্থা হয় মিসকিনদের মতো। হিন্দুরা ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ডাক্তার, প্রশাসক হয়ে ওঠে। তাদের উচ্চ পদ দেওয়া হয়। মুসলিমরা যদি তাদের সাথে পাল্লা দিতে না পারে তাহলে হিন্দুরাই শাসকশ্রেণীতে পরিণত হবে। এ জন্য সাইয়িদ আহমাদ খান কিছু বুদ্ধিজীবীর সাথে মিটিং করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদেরকে মুসলিমদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারা একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম আলিগড় কলেজ। পরবর্তীতে এটি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এটি আজ পর্যন্তও ভারতের অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের শিক্ষিত করা। ফলে মুসলিমরা শিক্ষাদান করতে শুরু করে। তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তারা শিখতে শুরু করে। তারা ইতিহাস শেখে, ইংরেজি ভাষা শেখে, গুরত্বপূর্ণ অন্যান্য শাস্ত্র শেখে। ফলে তারা ধীরে ধীরে সচেতন হতে শুরু করে। ফলে এখান থেকে একদল মুসলিম বুদ্ধিজীবী বেরিয়ে আসে যারা ছিল আপন শাস্ত্রে অত্যন্ত দক্ষ। মাওলানা শিবলী নোমানি, আল্লামা ইকবাল হচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবে আল্লামা ইকবাল সরাসরি আলিগড়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। তবে তার শিক্ষক থমাস আরনল্ড এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন।
তাই পরবর্তীতে যা ঘটে – পরবর্তীকালের সকল মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা কোনো না কোনোভাবে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটি ছিল সাইয়িদ আহমাদ খানের এক অভূতপূর্ব অবদান। তবে তিনি পরবর্তীতে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বতে পরিণত হন। তিনি এমন কিছু লেখা শুরু করেন যা নিষ্ঠাবান, সচেতন আলিমদের কাছে ভুল মনে হয়। অর্থাৎ, তার লেখাগুলো ইসলামের প্রকৃত চেতনার বাইরে যেতে শুরু করেছিল। ফলে আলিমরা তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেদের সরিয়ে ফেলতে শুরু করেন। ফলে তিনি ধর্মতাত্ত্বিকভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। তার কিছু ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কিছু আলিম তাকে তাকফির করেন।
তবে তিনি মুসলিমদের জন্য অনেক ভালো কাজও করেছেন। তিনি মুসলিমদের চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য তাদের শিক্ষিত করেন। ফলে স্বাধীনতার জন্য মুসলিমদের আন্দোলন শুরু হয়।
১৮৮০-র দশকে একদল হিন্দু, মুসলিম, জৈনদের হাতে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির যাত্রা শুরু হয়। ভারতীয়রা সবাই একত্রিত হয়। তারা বুঝতে পারে, ব্রিটিশরা আমাদের অধিকার আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে না। আমাদের নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে হবে। এই উদ্দেশে কংগ্রেস পার্টির যাত্রা শুরু হয়। তবে এখানে মুসলিমদের জন্য বিশেষভাবে কিছু ছিল না।
তবে ধীরে ধীরে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন যে এটি মূলত হিন্দুদের, বিশেষত সেকুলার হিন্দুদের একটি কংগ্রেস। তবে কিছু ধার্মিক হিন্দুও সেখানে ছিল। অর্থাৎ, কংগ্রেস যেহেতু হিন্দুদের তাই এটা মুসলিমদের চাহিদা বা সুবিধার প্রতিনিধিত্ব করবে না। আর ব্রিটিশরা যদি এখানে গণতন্ত্র রেখে যায় তাহলে মুসলিমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ার কারণে হিন্দুদের হাতে শাসিত হবে। অর্থাৎ, তারা এই ভবিষ্যৎটা দেখতে পাচ্ছিল। আর এটি সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয় সাইয়িদ আহমাদ খানের। তাই তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্ব নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, “ভারত মূলত দুটো জাতির মিশ্রণ – হিন্দু ও মুসলিম। তাই তাদের উভয়ের ভিন্ন স্বদেশ দরকার। তারা দুটো ভিন্ন জাতি। তারা ভৌগলিকভাবে এক জায়গায় থাকতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, পরিচয় ভিন্ন। তারা তারা একই মানুষ নয়।”
অন্যদিকে কংগ্রেস পার্টির দাবি ছিল যে, আমরা সবাই একই জায়গা থেকে। তাই আমরা সবাই এক।
সেসময় যেসব বাস্তববাদী মুসলিম নেতা ছিলেন, যারা সচেতনতার সাথে ভারতের ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন তারা জানতেন যে যদি তাদেরকে মুসলিম ব্যতীত অন্য কারো শাসনাধীনে ছেড়ে দেওয়া হয় অথবা তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যোগ্য মুসলিম নেতা না থাকে তারা প্রান্তিক হয়ে পড়বে, তাদের ওপর নৃশংসতা চালানো হবে। আর ঠিক এটাই বর্তমানে ভারতে ঘটছে। আজকে ভারতে যা ঘটছে তা প্রমাণ করে যে জিন্নাহ, ইকবাল, সাইয়িদ আহমাদ খানসহ অন্যান্য সকল মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সঠিক অবস্থানে ছিলেন। অন্যদিকে যারা গত ৭০-৮০ বছর ধরে বলে আসছে যে ভারতের বিভাজন একটি বাজে আইডিয়া ছিল, এটা ঘটা উচিত হয়নি, মুসলিমরা সংযুক্ত ভারতেই আরো ভালো থাকত – তাদের কোনো ধারণাই নেই তারা কি নিয়ে কথা বলছে। আপনার আমার কথা বিশ্বাস না হলে এখন ভারতের দিকে তাকান।
আপনি ভারতের দিকে তাকালে দেখবেন, এটি উগ্রবাদী ভারতীয় মতবাদ অর্থাৎ হিন্দুতভা দ্বারা পরিচালিত। তারা একটি হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তারা তাদের বক্তব্য বা উদ্দেশ্য লুকানোরও প্রয়োজন বোধ করে না। তারা বৃহত্তর ভারত প্রতিষ্ঠা করতে চায় যার নাম দিয়েছে “অখণ্ড ভারত”। অখণ্ড ভারত বলতে বৃহত্তর ভারত বোঝায় যার মধ্যে আছে মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের কিছু অংশ। তাই আমরা তাদের বলতে চাই, তোমাদের স্বাগতম। যাও আফগানিস্তানে যেয়ে তোমাদের অখণ্ড ভারতের দাবি তোলো। এসব বোকার স্বর্গদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত।