ব্রিটেনে একটি গল্প বেশ প্রচলিত। গল্পটি ব্রিটেনের ভারতের উপনিবেশিকরণ নিয়ে। উপনিবেশটা যতই ভয়ংকর হোক না কেন এটি ব্রিটেনের জন্য কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনেনি। বরঞ্চ, ভারতে প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে ব্রিটেনের নিজের পকেটের টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। কিন্তু এরপরও তারা ভারতের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল। কারণ তারা ভারতের জনগণের প্রতি আন্তরিক ছিল, তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিল।
উত্সা পাটনায়েক নামক এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছেন এবং দেখেছেন যে, ব্রিটেনের অনেকে ভারতে তাদের উপনিবেশ সম্পর্কে যে গল্প বলে তা সত্য না-ও হতে পারে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস[1] থেকে প্রকাশিত তার গবেষণা অনুসারে, ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছর ধরে ব্রিটেন ভারতের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ লুট করে নিয়েছিল। এই লুটের পরিমাণ মোট ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার।[2] এর মানে হল, ব্রিটেন আসলে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রচুর ধনী হয়েছে।
৪৫ ট্রিলিয়ন এক বিস্ময়কর সংখ্যা বটে। বর্তমানের সাথে তুলনা করলে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার যুক্তরাজ্যের বর্তমান মোট বার্ষিক জিডিপির চেয়ে ১৭ গুণ বেশি।[3]
কিন্তু এটা কীভাবে ঘটল?
এটা বানিজ্যব্যবস্থার মাধ্যমে ঘটেছে। ঔপনিবেশিককালের আগে ব্রিটেন ভারতীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে রূপা ও অন্যান্য মাধ্যমে টেক্সটাইল ও চালের মতো পণ্য ক্রয় করত। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং ভারতীয় বাণিজ্যের উপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৭৬৫ সালে কিছু পরিবর্তন হয়।।
কীভাবে কি ঘটল বলছি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আকারে টাকা নিতে শুরু করে। তারা চালাক ছিল। ট্যাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছু অংশ (প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) তারা ভারত থেকে পণ্য কেনার জন্য ব্যবহার করত যে পণ্যগুলো ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের নিজেদের টাকা দিয়ে এসব মালামালের দাম দিতে হতো না। পরিবর্তে, তারা ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্সবাবদ যা পেত সেটাই ব্যবহার করত। এটা হচ্ছে কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে এরপর সেই টাকা দিয়েই তার কাছ থেকে জিনিস কেনার মতো।
এটা ছিল এক মারাত্মক কৌশল, বিপুল টাকা মেরে দেওয়ার একটি পন্থা। কিন্তু আসলে কি ঘটছে তা ভারতের বেশীরভাগ মানুষ জানত না। কারণ যে ব্যক্তি ট্যাক্স নিত আর যে পণ্য কিনতে আসত তারা একই ব্যক্তি ছিল না। যদি একই ব্যক্তি হতো তাহলে তারা বুঝত কোথাও গড়বড় হচ্ছে।
চুরি করা পণ্যের কিছু ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হতো, আর বাকিগুলো আবার অন্যত্র রপ্তানি করা হতো। পুনঃরপ্তানি ব্যবস্থার কারণে ব্রিটেন ইউরোপের অন্যান্য অংশ থেকে বিভিন্ন জিনিস আমদানি সচল রাখতে পেরেছিল যার মধ্যে লোহা, আলকাতরা এবং কাঠের মতো উপকরণ রয়েছে, যা ব্রিটেনের শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে, শিল্পবিপ্লব ভারত থেকে এই পদ্ধতিগত চুরির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এ ছাড়া, ব্রিটেন তার চুরি করা পণ্য যে দামে ভারতীয়দের কাছ থেকে “কিনেছিল” তার চেয়েও চড়া দামে বিক্রি করত। একে তো তারা বিনা পয়সায় চুরি করেছে, তার ওপর দামও হাঁকাত কয়েক গুণ বেশী।
১৮৫৮ সালে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর, তারা অর্থ ও পণ্য গ্রহণের উপায় পরিবর্তন করে। আগে ভারত থেকে শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই পণ্য কিনতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর ভারতীয় জনগণ তাদের পণ্য অন্যান্য দেশেও বিক্রি করার অনুমতি পায়। তবে ব্রিটেন নিশ্চিত করে যে সেই পণ্যগুলির সমস্ত অর্থ যেন তখনও লন্ডনে যায়। এর মানে হল, ভারতীয় জনগণ তাদের পণ্যগুলো অন্য দেশে বিক্রি করলেও ব্রিটেন লভ্যাংশের ভাগ পেত, অর্থাৎ অর্থ উপার্জন করত।
কিন্তু কীভাবে? সংক্ষেপে বললে, কেউ ভারত থেকে পণ্য কিনতে চাইলে তাকে “কাউন্সিল বিল” নামে এক বিশেষ ধরনের অর্থ ব্যবহার করতে হতো। সোনা বা রূপা ব্যবহার করে এই বিলগুলো শুধুমাত্র লন্ডন থেকে কেনা যেত। সুতরাং, যারা পণ্য কিনতে চাইতো তাদেরকে লন্ডনের কাছে স্বর্ণ দিয়ে কাউন্সিল বিল নিতে হতো। এরপর সেই বিল দিয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মূল্য পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যখন বিল ভাঙ্গিয়ে অর্থ নিতে যেত, তখন তাদেরকে রূপী দেওয়া হতো। অথচ এই রূপীই ট্যাক্সের নামে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফলে তারা যে পণ্যগুলি তৈরি করেছিল সেগুলোর বিনিময়ে তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো অর্থ পায়নি। তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছিল।
অন্যদিকে ভারতীয়দের যেসব সোনা ও রূপা প্রাপ্য ছিল সেগুলো গিয়ে জমা হতে থাকে লন্ডনে।
এই অসাধু ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে, যদিও ভারত অন্য দেশ থেকে যে পরিমাণ আমদানি করত তার চেয়ে বেশী রপ্তানি করত – ফলে তাদের হাতে অধিক অর্থ থাকার কথা। কিন্তু রেকর্ড দেখে মনে হচ্ছিল তারা আসলে অর্থ হারাচ্ছে। কারণ ভারত পণ্য বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করত তা ব্রিটেনে যাচ্ছিল, ভারতে থাকছিল না। এটি ১৯০০-এর শুরুর দিকে প্রায় ৩০ বছর ধরে চলে।
কিছু লোক বলতে পারে যে, ভারত ব্রিটেনের জন্য বোঝা ছিল কারণ কাগজে-কলমে মনে হচ্ছিল ভারত ঋণগ্রস্ত। উৎপাদনের চেয়ে তাদের আমদানী বেশী। তারা ঘাটতিতে আছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটেন অনেক টাকা নিচ্ছিল যা যাওয়ার কথা ছিল ভারতের জনগণের কাছে। ভারত ছিল একটি হাঁসের মত যে সোনার ডিম পাড়ে, কিন্তু ডিম নিয়ে যাচ্ছিল ব্রিটেন। এই ভুয়া “ঘাটতির” কারণে ভারতকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য ব্রিটেনের কাছ থেকে অর্থ ধার করতে হয়েছিল। ফলে ভারত ব্রিটেনের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সহজ হয়।
ব্রিটেন তাদের যুদ্ধের জন্য এই অসাধু উপায়ে ভারত থেকে নেওয়া অর্থ ব্যবহার করেছিল। তারা ১৮৪০-এর দশকে চীন আক্রমণ করতে এবং ১৮৫৭ সালে ভারতে বিদ্রোহ দমন করতে এটি ব্যবহার করে। তারা তাদের যুদ্ধ পরিচালনার অর্থ সরাসরি নেয় ভারতের জনগণের কাছ থেকে। অর্থনীতিবিদ উত্সা পাটনায়েক বলেছেন যে, ব্রিটেন ভারতের বাইরে যে সমস্ত যুদ্ধ করেছিল তার ব্যয়ভার চালানো হয়েছিল প্রধানত ভারতের অর্থ দিয়ে।
শুধু তাই নয়। ব্রিটেন ভারত থেকে যে অর্থ নিয়েছিল তা ইউরোপের পাশপাশি ইউরোপীয়রা যেসব জায়গায় বসবাস করে যেমন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় পুঁজিবাদ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। এর অর্থ হল, ভারত থেকে নেওয়া অর্থের কারণে শুধু ব্রিটেনের শিল্পায়ন হয়নি বরং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক শিল্পায়নও এর কারণে ঘটেছে।
উপনিবেশ ভারতে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যবর্তী সময়টাকে চারটি অর্থনৈতিক পর্যায়ে ভাগ করেন। এরপর তিনি বের করেন সে সময়ে ব্রিটেন কত টাকা ভারত থেকে পাচার করেছে। সেখান থেকে দেখেন, ব্রিটেন মোট ৪৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে। এই সংখ্যাটি হচ্ছে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন সংখ্যা। তা ছাড়া, ব্রিটেনের পলিসির কারণে ভারতকে ব্রিটেন থেকে যে পরিমাণ অর্থ ঋণ করতে হয়েছিল তা এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে বৃহৎ। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি কত হয়েছে তা গণনা করা সম্ভব না। যদি ভারত তার নিজের দেওয়া ট্যাক্স ও বৈদেশিক বানিজ্যের অর্থকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারত জাপানের মতো তাহলে নিঃসন্দেহে ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো। ভারতও হতে পারত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পাওয়ারহাউজ। বছরের পর বছর ধরে চলা দারিদ্র্যতা ও দুর্দশা মোকাবেলা করা যেত।
এই ধারণাগুলি সঠিক নয়। সাম্প্রতিক গবেষণার ফলগুলোও ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাসবিদ নিল ফার্গুসন এবং ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন বলেছেন, ব্রিটিশ শাসন ভারতের বিকাশে সহায়তা করেছিল এবং এটি সামগ্রিকভাবে ভারতের জন্য কল্যাণকর ছিল।[4] কিন্তু এই ধারণাগুলো মোটেও সত্য নয়।
২০১৪ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ব্রিটেনের অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে উপনিবেশবাদ সেসব দেশের জন্য ভালো ছিল।[5] এই ব্যাপক প্রচলিত ধারণা ডাঁহা মিথ্যা।
অথচ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পুরো ২০০ বছরের ইতিহাসে ভারতের জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়নি বললেই চলে।[6] বরঞ্চ ১৯ শতকের শেষার্ধে – ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের সময় – ভারতের জনগণের মাথাপিছু আয় অর্ধেকে কমে যায়। ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভারতীয়দের গড় আয়ু এক-পঞ্চমাংশ হ্রাস পায়। ব্রিটিশ শোষণমূলক পলিসির কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি লোক মারা গেছে।
ব্রিটেন ভারতের উন্নয়ন করেনি, বরং ঠিক উলটোটা করেছে। পাটনায়েকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতই ব্রিটেনকে গড়ে গিয়েছে।
এসবের জন্য ব্রিটেনের আজ কি করা উচিত? ক্ষমাপ্রার্থনা? অবশ্যই। ক্ষতিপূরণ? হয়তো। তবে এটা অসম্ভব। কারণ ব্রিটেন যে অর্থ লুট করেছে তা ব্রিটেনের সব সম্পদ জড় করলেও তা শোধ করা যাবে না। অন্যদিকে বরং আমরা আমাদের বক্তব্যের ভাষ্যটা সরল করি। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ব্রিটেন ভারতের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল উদারতার জন্য নয় বরং লুণ্ঠনের জন্য। ব্রিটেনের শিল্পখাতে উত্থান স্টিম ইঞ্জিন এবং বিভিন্ন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের কারণে ঘটেনি, বরং ঘটেছে অন্যের জায়গা থেকে ব্যাপক চুরি ও লুন্ঠনের মাধ্যমে।
বিঃদ্রঃ https://www.aljazeera.com/opinions/2018/12/19/how-britain-stole-45-trillion-from-india – থেকে অনূদিত।
রেফারেন্সঃ
[1] https://cup.columbia.edu/book/agrarian-and-other-histories/9789382381952
[2] https://www.livemint.com/Companies/HNZA71LNVNNVXQ1eaIKu6M/British-Raj-siphoned-out-45-trillion-from-India-Utsa-Patna.html?utm_source=scroll&utm_medium=referral&utm_campaign=scroll
[3] https://tradingeconomics.com/united-kingdom/gdp
[4] https://www.gov.uk/government/news/press-briefing-given-by-prime-minister-david-cameron-in-amritsar
[5] https://yougov.co.uk/topics/lifestyle/articles-reports/2014/07/26/britain-proud-its-empire
[6] https://www.versobooks.com/books/2311-late-victorian-holocausts