গাসসানের বাবা তার দুই যুবক সন্তানের চিন্তা-চেতনায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন। গাসসান এবং তার ভাই রামি দুজনেই প্রতিদিন সকালে তাদের বাবার রুমে আসে এবং হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘বাবা, দয়া করে খরচের টাকাটা দিন।’ এ তাদের নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াল। বাবা যখন তাদেরকে হাত খরচের টাকা দেয় তখন তারা শুকরিয়া জানিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। গাসসানের বাবা তার দুই ছেলেকে এই ব্যাপারটি মনে করিয়ে দিতে চাইলেন যে, তাদের সাথে তার সম্পর্কটা খরচের টাকা দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
দুই ভাই পরদিন এসে আবারও খরচের টাকা চাইল। কিন্তু বাবা টাকা দিলেন না। বরং ভালোবাসা ও স্নেহ নিয়ে বললেন, “আমি তোমাদেরকে ভালোবাসি।”
বাবা আশা করেছিলেন, তাদের চোখে চোখ রেখে যখন তিনি এ কথাগুলো বলবেন, তখন তাদের চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠবে। তিনি আশা করেছিলেন, তার ছেলেরাও তাকে এভাবেই ভালোবাসবে। বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র হাতখরচের জন্য হবে না। কিন্তু তার সে আশায় গুড়েবালি।
আমরাও তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলে দুই ছেলে আবার তার পকেটের দিকে তাকিয়ে রইল। কারণ তিনি ওখান থেকেই তাদের খরচের টাকা বের করে আনেন।
ছেলেদের এমন কারবার দেখে তিনি বড্ড আঘাত পেলেন এবং নিমিষেই তার হাসিমাখা মুখ বিষাদে ছেয়ে গেল। হঠাৎ করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় দুই ছেলেই সতর্ক হয়ে উঠল। বাবার স্নেহসুলভ কথার জবাবে তাদের অমন কর্কশ আচরণ করার ব্যাপারটি তারা বুঝতে পারল। তাই দুজনেই হাত গুটিয়ে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইল। রামি বলল, “বাবা, আমি খুব দুঃখিত। সত্যিই আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি তো আমার বাবা। আমাকে পেলেপুষে বড়ো করেছ। নিজের প্রয়োজনের জন্য তুমি ছাড়া আর কার কাছে যাব বলো?” রামি মুখ দিয়ে কথাগুলো বলে গেলেও তার চিন্তা-ভাবনায় হাত খরচার ব্যাপারটিই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে প্রত্যাশা করছিল, এবার তার বাবা সুন্দরভাবে পকেটে হাত ঢুকিয়ে খরচের পয়সা দিয়ে দেবেন। কিন্তু এমন কিছুই ঘটল না। তিনি চুপচাপ রইলেন। এবার রামি বলল, ‘বাবা, আসলেই টাকাটা আমার প্রয়োজন। আমি ওয়াদা করছি এখন থেকে আরও সুন্দর ও কোমলভাষায় তোমার সাথে কথা বলব। তবুও তুমি টাকাটা দিয়ে দাও।”
এই কথার পরেও বাবার অবস্থান যখন নড়চড় হলো না, তখন সে মেজাজ খারাপ করে চেঁচাতে চেঁচাতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
অন্যদিকে গাসসানকে পুরো ব্যাপারটা বিব্রত করল। সে বাবাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে। তবে অতীতে বাবার থেকে নিয়মিত হাত-খরচা নেওয়ার ফলে সত্যিকার ভালোবাসাটাতে কিছুটা ঘুণ ধরেছিল। কিন্তু এখন বাবার এমন নীরস ও ভারাক্রান্ত মুখ দেখে তার লুকোনো অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে অনুভব করল, ইদানীং কত কত ব্যাপারে সে তার বাবার হক আদায়ে অলসতা করেছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, সে অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠছে। বাবার (ভালোবাসার) অনুভূতির কোনো তোয়াক্কা করছে না। তার অন্তরে আনন্দের হাসি ফোটানোর কথা ভাবছে না। শুধু নিজের প্রয়োজন সারতে পারলেই কেল্লা আর ভিন্ন কিছু ভাবে না। কেবল নিজের চিন্তাটাই করছিল সে।
এসব কথা চিন্তা করে তার দু-চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল— প্রিয় বাবা, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি অনেক অসচেতন ছিলাম। দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আপনার সামান্য একটু হাসির সামনে আমার কাছে পুরো দুনিয়া তুচ্ছ….
গাসসান কথা বলছিল আর দু-হাত দিয়ে তার অশ্রু মুছে যাচ্ছিল। সে চাচ্ছিল, তার বাবার মলিন মুখে যেন হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিন্তু বাবা আগের মতোই গোমড়া হয়ে রইলেন। মুখে আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। তারপর উঠে অন্য রুমে চলে গেলেন। কারও সাথে কোনো কথা না বলে চুপচাপ সোফায় বসে রইলেন।
গাসসান হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে বিড়ালের মতো বাবার চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। একবার বাবার হাতে চুমু খায়। পরক্ষণেই তার মাথায় চুম্বনের ছোঁয়া এঁকে দেয়। একবার বাবার দু-হাত তার হাতের মাঝে নিয়ে বসে থাকে। তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। সে বারবার বলে যাচ্ছে, ‘বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এটা তো তুমি জানোই। আশা করি আমাকে ক্ষমা করবে।’
গাসসানের এই কাণ্ড দেখে বাবার বুকের ভেতর ভাবনা ও অনুভূতির তরঙ্গ দোলা দিতে থাকে। তিনি নিজের সন্তানকে বেশিক্ষণ এই অবস্থায় দেখতে চান না। কিন্তু শুরুতে তাদের অমন রুক্ষ আচরণের ঘা এখনও তার দিলে তাজা হয়ে আছে। তিনি তাই আরেকটু শিক্ষা দিতে চাইলেন তাকে। চুপচাপ উঠে গিয়ে তাকে বাইরে রেখে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন।
গাসসান এবার আরও উতলা হয়ে উঠল। দরজার ওপাশ থেকেই সে চিৎকার করে বলতে লাগল—বাবা, তোমাকে অসন্তুষ্ট ও ভারাক্রান্ত দেখে আমি বাঁচতে পারব না। আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। প্লিজ, তুমি একটু আমার ওপর দয়া করো। জানি, আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু আমি তো তোমাকে দিল থেকে ভালোবাসি। আশা করছি তুমি আমাকে মাফ করে দেবে। অপেক্ষা করছি, তোমার মুখে আবার হাসির ঝিলিক দেখতে পাব। তুমি আমাকে তোমার বুকে টেনে নিবে সেই আশায় আছি…
গাসসানের কান্নার ধ্বনি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। যেন সে ছোট শিশু। তার মা তাকে জনশূন্য মরুভূমিতে একাকী ফেলে কোথাও চলে গেছে।
গাসসানের অশ্রুসজল চোখের চাহনি তার বাবার মনের সকল কষ্ট মোমের মতো গলিয়ে দিল। বাবার হৃদয়ে পুঞ্জিভূত হয়ে থাকা সকল বেদনা যেন ঝাড়ো বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তিনি এবার দরজা খুললেন এবং বাইরে দাঁড়িয়ে-থাকা সন্তানকে কাছে টেনে নিলেন। দু-হাত দিয়ে ধরে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তার চোখ থেকে অশ্রু মুছে দিলেন। মাথায় আলতো চুমুর পরশ বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু গাসসানের চোখ থেকে অশ্রুধারা অনবরত গড়িয়ে পড়তে লাগল। এই অশ্রু আনন্দের।
বাবা এবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে গাসসানের হাত খরচ দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বাবাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘এসব থাক। তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হলেই হবে। তুমি যদি সন্তুষ্ট থাকো, তা হলে পুরা দুনিয়া আমার কাছে তুচ্ছ।’
আল্লাহ তাআলা জানেন তাঁর বান্দাদের ভালোবাসার মধ্যে অনেক সময়ে ভেজাল থাকে। তাঁর দেওয়া দুনিয়াবি বিভিন্ন নিয়ামাতের সাথে তাদের ভালোবাসা সংযুক্ত থাকে। তিনি তাঁর বান্দাদের ভালোবাসাকে ভেজালমুক্ত করতে চান। তাই যদি কারও ভেতর এই ধরনের পরিস্থিতি দেখতে পান, তখন তার থেকে নিয়ামাতের ধারাকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। যাতে করে সে গাফিলতির নিদ্রা থেকে জেগে ওঠে এবং আল্লাহ তাআলার নিয়ামাত ও তার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যায়।
রামি’র মতো যাদের চিন্তা-ভাবনা, তারা এ ব্যাপারগুলো বুঝবে না। এরা সব সময় গাফিলতির নিদ্রায় গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে থাকে। কীভাবে আল্লাহর কাছ থেকে বিভিন্ন নিয়ামাত পাওয়ার ধারাকে সচল রাখা যায়, এদের চিন্তা-চেতনায় কেবল এ (জিনিসটাই ঘুরপাক খেতে) থাকে। (দুনিয়া পাবার) জন্যই এরা আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করে, বেশি পরিমাণ ইবাদাত করে। যেন আল্লাহ তাআলা নিয়ামাতের ধারাকে কখনও বন্ধ না করেন। আল্লাহ তার ওপর ক্রোধান্বিত হচ্ছেন কি না, এটা নিয়ে সে অতবেশি চিন্তিত নয়। তার সকল ধ্যান-জ্ঞান-দুশ্চিন্তা কেবল এই ব্যাপারটি নিয়ে যে, আল্লাহ তার থেকে যে-কোনো সময় নিয়ামাতকে ছিনিয়ে নিতে পারেন। এগুলো হলো সস্তা চিন্তা-ভাবনা এবং নীচু শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি। এই ধরনের লোক কেবল নিজের স্বার্থটাই চিন্তা করে। তার দায়িত্ব কী, সেই বিষয়ে থাকে সে পুরোপুরি বেখবর।
আর যাদের অবস্থা গাসসানের মতো, দুনিয়াবি নিয়ামাত তাদের হাতছাড়া হলে তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা সরে যায় এবং এই বিপদের বাস্তবতা তারা অনুধাবন করতে পারে। তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহর অধিকার আদায়ে তার গাফিলতি এবং অবহেলা রয়েছে। তখন তার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে কীভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে এবং তার ভালোবাসা অর্জন করবে। আর নিয়ামাত ফিরে পাওয়াটা হচ্ছে পরের বিষয়। কারণ নিয়ামাত ছাড়াও কষ্ট করে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা এবং তার সঙ্গ ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
শেষপর্যন্ত দেখা যায় এই উভয় শ্রেণীকেই আল্লাহ তাআলা নিয়ামাত ফিরিয়ে দেন। কুরআনে তিনি বলেছেন,
كلا نية هَؤُلاء وَهَؤُلَاءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ وَمَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُورًا
“এদের ও ওদের প্রত্যেককে আমি তোমার রবের দান থেকে সাহায্য করি, আর তোমার রবের দান বন্ধ হওয়ার নয়।” [সুরা আল-ইসরা : ২০]
তবে প্রথম শ্রেণীর যারা, তারা হচ্ছে অনুভূতিশূন্য। একটা সময়ে তারা বিপদ থেকে মুক্তি পায় ঠিকই, তবে এই বিপদ থেকে উপকৃত হতে পারে না। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে নিয়ামাতকে ফিরে পাওয়া। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর যারা, তাদের জন্য এই বিপদ বিরাট বড়ো নিয়ামাত হয়ে দেখা দেয়। ফলে তারা নিজেদেরকে গাফিলতি এবং অসচেতনতা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণভাবে উৎসর্গ করতে পারে। এই উভয় শ্রেণী কখনও সমান হতে পারে না।
ড. ইয়াদ কুনাইবির লেখা অবলম্বনে