হিমাগারে আলু সংরক্ষণের খরচ বাড়ল। এখন থেকে প্রতি কেজি আলুতে কৃষক পর্যায়ে দেড় থেকে দুই টাকা বেশি খরচ পড়বে। সে হিসাবে আলুর জন্য বিখ্যাত দেশের উত্তরের তিন জেলা—বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ের ৭১টি হিমাগারে আলু রাখতে ১১৮ কোটি টাকার বাড়তি বোঝা কৃষকের ঘাড়ে চাপছে।সম্প্রতি হিমাগারের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের এক সভার সিদ্ধান্তে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ভাড়া বাড়ানো হয়। চলতি মৌসুম থেকে হিমাগারে এক কেজি আলু সংরক্ষণের বিপরীতে কৃষককে ৫ টাকা ২০ পয়সা গুনতে হবে। এর প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। ক্রেতাদেরও বেশি দামে আলু কিনে খেতে হবে। দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। তার আগেই আলু সংরক্ষণের ব্যয় বাড়ল।ভাড়া বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, গত মৌসুমে বাজারে মূল্যধসের কারণে হিমাগার থেকে আলু বের না হওয়ায় লোকসান দিতে হয়েছে মালিকদের। এ ছাড়া এবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি আশঙ্কা, ডিজেল ও মবিলের মূল্যবৃদ্ধি, সংরক্ষণের খরচ বৃদ্ধি, লোডিং-আনলোডিংয়ে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
হিমাগারের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বগুড়া জেলায় হিমাগার আছে ৩৬টি; জয়পুরহাটে ২০টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৫টিসহ এই তিন জেলায় মোট ৭১টি হিমাগার আছে। বগুড়ার হিমাগারগুলোতে ৩ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন, জয়পুরহাটে ১ লাখ ৮৫ হাজার এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হিমাগারগুলোতে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। বগুড়া ও জয়পুরহাটের হিমাগারে আলু রাখতে প্রতি কেজির বিপরীতে কৃষকের বাড়তি ১ টাকা ৯২ পয়সা ব্যয় হবে। আর ঠাকুরগাঁওয়ে বাড়তি ১ টাকা ৬৩ পয়সা বেশি খরচ হবে। সে হিসাবে তিন জেলায় আলু সংরক্ষণের পেছনে এখন থেকে কৃষকদের ওপর ১১৯ কোটি টাকার খরচের বোঝা চাপছে। হিসাব করে দেখা যায়, বগুড়া-জয়পুরহাটে খরচ বাড়বে ৯৬ কোটি টাকা। আর ঠাকুরগাঁওয়ে বাড়বে ২২ কোটি টাকা।
বিদ্যুতের দাম বাড়ার আগেই বাড়ল আলু রাখার খরচ
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ২২৮টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণে ধারণক্ষমতা ১৯ লাখ ৪২ হাজার ২৮ মেট্রিক টন। প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের ভাড়া ৫ টাকা ২০ পয়সা বেঁধে দেওয়ায় সংরক্ষণকারীদের এবার ৩৭২ কোটি ৮৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে।মার্চ থেকে নভেম্বর হিমাগারে আলু সংরক্ষণের মৌসুম। মৌসুম শেষে হিমাগার থেকে আলু বের করার সময় ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। চলতি মৌসুম শেষে বাড়তি দামে হিমাগারভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে উদ্বেগে আছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় ৪০ ভাগ বেশি আলু উৎপাদিত হয়। বিদেশে আলু রপ্তানি করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় আলু বেশি হওয়ায় দাম কমে যাচ্ছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এর মধ্যে হিমাগারভাড়া বাড়ানো হলে কৃষকেরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
আলু সংরক্ষণের ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আলুচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির ব্যানারে মানববন্ধন করেন আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা। ঠাকুরগাঁও জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হক বলেন, প্রতিবছরই হিমাগারমালিকেরা চাষিদের সঙ্গে ছলচাতুরী করেন। গত বছর হিমাগারে আলু ঢোকানোর আগে কম ভাড়ার কথা বলে মালিকেরা পরে বেশি ভাড়া দাবি করেন।
এদিকে চাষিরা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। এত বাড়তি ব্যয় করে হিমাগারে আলু রেখে পরে ভালো দাম পাওয়া যাবে কিনা, সেই সংশয়ে পড়েছেন তাঁরা। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, বাড়তি দামের বোঝা ভোক্তার ওপর চাপবে।ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঢোলারহাট গ্রামের আলুচাষি অনিল রায় বলেন, এখন বাজরে আলুর দাম কেজি ১৩ টাকা। হিমাগারে রাখতে বস্তা, পরিবহন ও শ্রমিক খরচ রয়েছে। সেটাও দুই থেকে তিন টাকা পড়ে যায়। আবার আলু বিক্রির সময় প্রতি মণের সঙ্গে দু-তিন কেজি করে অতিরিক্ত দিতে হয়। সেসব খরচের সঙ্গে হিমাগারভাড়াসহ অন্য খরচ যোগ করে আলু বিক্রি করতে হবে। এতে ক্রেতাদেরও বেশি দামে আলু কিনে খেতে হবে।
মুন্সিগঞ্জে ভাড়া না-ও বাড়তে পারে
আমাদের মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার হিমাগারগুলোতে এ বছর আলু সংরক্ষণের ভাড়া বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন হিমাগার ব্যবসায়ীরা। জেলায় আলু সংরক্ষণের জন্য ৬৪টি সচল হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যাবে।দেওয়ান কোল্ড স্টোরেজের মালিক আরশ দেওয়ান বলেন, তাঁর হিমাগারে সাত লাখ বস্তা আলু রাখা হয়। গত বছর ৫০ কেজির বস্তা ২০০ টাকা করে ভাড়ায় রাখা হয়েছিল। এবারও একই ভাড়ায় রাখা হবে।