মানুষ যখন এ ধরণের প্রশ্ন করে তখন সত্যিকার অর্থে তারা যা বোঝায় তা হল: বিজ্ঞান কি সৃষ্টিকর্তাকে আবিষ্কার করতে পারবে? এটা বুঝতে হলে প্রথমে প্রুফ এবং আবিষ্কার এ দুটির পার্থক্য বুঝতে হবে! প্রুফ বা প্রমাণ করার অর্থ কোন একটি ফ্যাক্ট বা তত্বকে বা কোন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা।
আবিষ্কার বলতে কিছু দেখা, কিছুর খোজঁ পাওয়া বা কিছু সম্বন্ধে জানা বোঝায় যা আগে কেউ জানত না। আবিষ্কারকে চোখ দিয়ে দেখা যায়। অন্যদিকে প্রমাণ করার জন্য সেটি যে চোখ দিয়ে দেখতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বিজ্ঞান কিন্তু সবসময়ই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যে তার ছাপ দেখতে পায় অর্থাৎ বিজ্ঞান প্রমাণ করতে পারে সত্যিই সৃষ্টিকর্তা আছেন।
কিন্তু বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা কোনদিনও আল্লাহকে আবিষ্কার করতে পারব না এই দুনিয়ায়, কারণ তাকে চোখে দেখা যায়না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিজ্ঞান আল্লাহর অস্তিত্ব জানান দিতে পারলেও কেন তাকে আবিষ্কার করতে পারে না? এর উত্তর হচ্ছে, আল্লাহ তার সৃষ্টির মধ্যেই তিনি যে আছেন এমন কিছু ক্লু ঢুকিয়ে দিয়েছেন যার দ্বারা মানুষ তার অস্তিত্বের কথা বুঝতে পারে এবং তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে।
এই দুনিয়া একটা পরীক্ষা মাত্র। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং খুবই সামান্য ক্ষমতা দিয়েছেন।
ধরুন, আপনি একজন থ্রিডি ডিজাইনার যিনি কম্পিউটারে সফটওয়্যার এর মাধ্যমে থ্রিডি মডেল ডিজাইন করেন। এরপর আপনি সেই মডেল গুলোকে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে দিলেন। তাদের বুদ্ধিমত্তা আছে। এখন আপনি তাদের একটা টেস্ট দিলেন যেটি হচ্ছে তাদের আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের হাতে দুটি অপশন আছে। প্রথম অপশন, তারা আপনাকে সরাসরি দেখবে। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়, তাহলে তো আর এটা পরীক্ষা থাকল না। কারণ আপনি নিজেই নিজেকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় অপশন হচ্ছে তারা আপনাকে আবিষ্কার করবে। কিন্তু এটাও সম্ভব নয় কারণ আপনি কম্পিউটারের প্রজেক্টের বাইরে কম্পিউটার টেবিলে বসে আছেন।
তারা আপনাকে আবিষ্কার করতে পারবে না তার মানে এই না যে আপনার অস্তিত্বই নেই। কিন্তু আপনি তাদেরকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছিলেন। তারা যেন অন্তত আপনার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারে এজন্য দিয়েছিলেন কিছু প্রমাণ অর্থাৎ এভিডেন্স আর ক্লু। এরপরও যদি তারা আপনার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এর অর্থ হবে তাদের বুদ্ধি তাদের অহংকারী করেছে। কারণ, তারা জানে যে আপনি আছেন। তাই আপনাকে দেখতে না পাওয়ার কারণে আপনাকে অস্বীকার করা মূলত থ্রিডি মডেলগুলোর ঔদ্ধত্য প্রমাণ করে।
এই উদাহরণ এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে দেন। এই মডেলটা দুনিয়ার কিছু নীতি যেমন: বল, ত্বরণ, চলাফেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল। এই মডেল আসলে আমরাই। আর আমরাই সময়ের সাথে সাথে নীতিকে ব্যবহার করছি। আমাদের বুদ্ধিমত্তা সীমিত। আমরা ততটুকুই চিন্তা করতে পারি যতটুকুর ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন। আর আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্যই আমরা ভাবি আমরা যা দেখতে পাই না এর বাইরে কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
আপনি যদি এরকম কোন প্রজেক্ট (থ্রিডি মডেল) তৈরী করতে পারেনও তাও কিন্তু বলা যাবে না আপনি সর্বময় সৃষ্টিকর্তা। কারণ আপনি মডেল বানাতে ব্যবহার করেছেন ইলেকট্রিসিটি, আপনার ব্রেইন ইত্যাদি যার মূল উৎস মহামহিম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ।
আবার ভাবুন, আপনি, আপনার প্রজেক্ট, এই বিশ্বজগত সবকিছুই একটা সুবিশাল প্রজেক্টের অন্তর্গত। আপনার কি মনে হয় না একটা অত্যন্ত শক্তিশালী কম্পিউটার এসব বানিয়েছে? কম্পিউটার না হয়ে যদি এটা হয় বিশাল এক বাক্স? এই বাক্সের ভেতরে যখন থাকি তখন আমরা স্পর্শ, দেখা, শোনা বা স্বাদ নিতে পারি যা দিয়ে আমরা বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করতে পারি। কিন্তু ভালোবাসা, বুদ্ধিমত্তা, আবেগ ইত্যাদি চোখ,কান ব্যবহার করেও আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। আপনি তো আর এসব দেখতে পাবেন না। অথবা ভালোবাসা বা চিন্তাভাবনা কেও আবিষ্কার করতে পারবেন না।
আপনি এসব দেখতে পান না, শুনতে পান না এর অর্থ কি ভালোবাসা বা আবেগ নেই? যদিও আপনি এদের ফিজিক্যাল অবস্থাকে আবিষ্কার করতে পারবেন না কিন্তু বিভিন্ন এভিডেন্স এবং যুক্তি দিয়ে খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারবেন তাদের উপস্থিতি। কাউকে কাঁদতে দেখা দু:খময় অনুভূতির জানান দেয়, অথবা আপনার আ্যানালাইসিস করা ডাটা প্রমাণ করে আপনি বুদ্ধিমান। আর এসব কিছুই ঘটছে সেই বিশাল বাক্সের মধ্যে। সৃষ্টিকর্তার অবস্থান এর বাইরে। তাই ভালোবাসা, আবেগ যেভাবে অনুভব করা যায় সৃষ্টিকর্তাকে আপনি সেভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন না। কারণ তিনি তো আবিষ্কারযোগ্যই নন। তার অস্তিত্ব আমাদের কল্পনাশক্তি এবং বিশ্বজগতকে ছাপিয়ে যায়। ফিজিক্সের সূত্র তার অস্তিত্বের জানান দিতে পারে না কারণ তিনি কোন ‘ল’ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত নন। বরং তিনিই সকল ফিজিক্সের ‘ল’ এর প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু তাকে আবিষ্কার করতে না পারলেও যুক্তি এবং প্রমাণ এর মাধ্যমে তার উপস্থিতি আমরা টের পাই!
কোন কিছু প্রমাণ করার জন্য সেটাকে দেখা বা ধরতে পারা কি আসলেই প্রয়োজন? যদি আল্লাহকে দেখা যেত দুনিয়াতে বা ছোঁয়া যেত তাহলে কি তিনি আসলেই সৃষ্টিকর্তা হতেন? সৃষ্টিকর্তা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন।
আপনি নিশ্চয়ই আপনার দাদার দাদার দাদার দাদার বাবাকে দেখেননি তার মানে তো এই না যে তিনি ছিলেন না। তিনি না থাকলে আপনার দুনিয়ায় আসা সম্ভব হতনা। এটা আমাদের বিবেকবান বুদ্ধিমত্তা কোন সাইন্টিফিক প্রুফ ছাড়াই প্রমাণ করতে পারে।
এই ইউনিভার্স এর ডিজাইন অত্যন্ত জটিল এবং প্রতিটা মুহুর্ত অতিবাহিত হচ্ছে সূক্ষ্ম ক্যালকুলেশনের মাধ্যমে। এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন এক আল্লাহ যাকে আমরা দেখতে না পেলেও তার নিয়ন্ত্রণই তার অস্তিত্বকে নিশ্চিত করে।
আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। আর অনেক পদার্থবিদ এটা বিশ্বাস করেন। এটা তারা কিছু নতুন আবিষ্কার এর মাধ্যমেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। আণবিক পদার্থে কিছু সংখ্যা রয়েছে যেমন একটি ইলেকট্রন এর ভর, ওজন, কোয়ার্ক এর ওজন, মহাকর্ষ বল, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের শক্তি এরপর প্রায় ২০টা সংখ্যা যা পৃথিবীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু কেউই জানে না কেন তাদের ওই নির্দিষ্ট মান রয়েছে৷
আপনি বলতে পারেন: তাতে কি হয়েছে? ইলেকট্রনের ভরের মান কিছুটা বাড়ালে বা কমালে সমস্যা নেই তো। কিন্তু কথা হচ্ছে: সমস্যা আসলে আছে। এসব ক্ষুদ্র মানের যদি অতিক্ষুদ্র পরিবর্তনও আসত তাহলে এই দুনিয়া এমন আচরণ করত যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। পৃথিবী গায়েব হয়ে গেলেও অবাক হওয়া যেত না।
বিগ ব্যাং যখন হয় ঠিক তার পরবর্তী মূহুর্তে যদি আমরা ফ্ল্যাশব্যাকে যাই এই সময় পুরো ইউনিভার্স এর প্রসারণ ঘটছিল আর ম্যাটার সৃষ্টি হচ্ছিল! এই প্রসারণের হার যদি .০০০০০০০০০০০০০০১ (দশমিকের পর ১৫ ডিজিট) বেশিও হত তাহলে কোন গ্যালাক্সিই সৃষ্টি হতে পারত না| আর এই হার যদি -.০০০০০০০০০০০০০০১ কম হত তাহলে পুরো ইউনিভার্স ধ্বংস বা কোলাপ্স করত (তার সর্বোচ্চ আয়তনে পৌঁছে যাবার জন্য), আর এখ এখানে বসে এই আর্টিকেল রংপুর ডেইলিতে লেখা সম্ভব হত না।
নিশ্চয়ই এই বিশ্বজগতের বাইরে থেকে সবকিছুর উপর নজর রেখেছেনক কেউ, যিনি সৃষ্টি করেছেন সবকিছু নিপুণ হাতে, অসীম দক্ষতার সহিত। গণণায় একটুও ভুল হয়নি তার, কারণ ভুল করা সৃষ্টার বৈশিষ্ট্য নয়৷ আর সবকিছুই তিনি করেছেন কেবলমাত্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে। আল্লাহ মহান। আর তিনি নিজেকে এমন মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করেন। যেটা শুধু তারই প্রাপ্য। তিনি নিজেকে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করতে চান না। তিনি পৃথিবীতে কেবল তার জ্ঞান আর শক্তির প্রকাশ দেখিয়েছেন।
لَا تُدۡرِکُهُ الۡاَبۡصَارُ ۫ وَ هُوَ یُدۡرِکُ الۡاَبۡصَارَ ۚ وَ هُوَ اللَّطِیۡفُ الۡخَبِیۡرُ ﴿۱۰۳﴾
চক্ষুসমূহ তাকে আয়ত্ব করতে পারে না। আর তিনি চক্ষুসমূহকে আয়ত্ব করেন। আর তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত। [সুরা আনআমঃ ১০৩]
তবে জান্নাতীদেরকে আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখার সুযোগ করে দেবেন। এর চেয়ে উত্তম পুরষ্কার আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে পরীক্ষা করছেন যেন আমরা তাকে না দেখেই তার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করি।