রাজধানীর নবাবপুরের ৬ নম্বর বাড়িটিতে মাঝেমধ্যে সংস্কারের দরকার হয়। হাত পড়ে না শুধু এক জায়গায়, দোতলায় ওঠার সিঁড়িটায়। দেড় হাত চওড়া কালো সিঁড়িটা ছিল বাড়ির একমাত্র ছেলের দখলে। বই পড়া বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার প্রিয় জায়গা সেটা। বিয়ের পর ছেলের সংসারও প্রথম শুরু হয় এই দোতলায়। সে অনেক দিন আগের কথা। তবে মা সালেহা মনির বলছিলেন, সন্তান হারানো মায়ের কাছে সব স্মৃতিই গতকালের।সালেহা মনির তাঁর একমাত্র ছেলে সাগর সরওয়ারকে হারিয়েছেন ঠিক ১০ বছর আগে এই দিনে (২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি)। সেদিন সাগরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মেহেরুন রুনিও পশ্চিম রাজাবাজারে তাঁদের ভাড়া বাসায় খুন হন। হত্যার বিচার তো দূরের কথা; কে বা কারা কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটাল, সেটা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। সেটা জানার অপেক্ষায় থেকে থেকে গত ৫ জানুয়ারি মারা গেছেন মেহেরুন রুনির মা নূরণ নাহার মির্জা। আরেক মা সত্তরোর্ধ্ব সালেহা মনির এখনো বেঁচে আছেন। সাগরের জন্ম থেকে বেঁচে থাকা সময়ের প্রতিটি স্মৃতিই তাঁর কাছে স্পষ্ট।
যন্ত্রণার এক দশক পার করার পর দেশের বিচারব্যবস্থা ও তদন্ত নিয়ে অনেকখানি হতাশ সাগরের মা। বললেন, ‘বিচার নিয়ে আর ভাবি না।’সন্তান হারানো এই মায়ের কাছে আনন্দ আর বেদনা এখন একই অনুভব। গত রোববার নবাবপুরের বাড়িতে সাগরের মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ প্রতিবেদকের। এত বছরেও সাগর-রুনির খুনি ধরা পড়েনি, সেই আক্ষেপের কথা বলতে বলতে পুরোনো অ্যালবামে সাগরের শৈশবের ছবি বের করলেন। বললেন, ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা খুব আবেগপ্রবণ এবং চাপা স্বভাবের ছিল।আড়াই বছর বয়সে সাগর একবার যমুনা নদীতে পড়ে গিয়েছিল, অ্যালবাম ওলটাতে ওলটাতে সেই স্মৃতি মনে পড়ে সালেহা মনিরের। বলছিলেন, ‘পাবনা কাজীরহাটে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে মাছ ধরা দেখতে ফুফাতো বোনের সঙ্গে গিয়েছিল সাগর। জাল তোলার সময় বাঁশের চার নেমে গেলে ফুফাতো বোনের সঙ্গে সাগরও নদীতে পড়ে যায়। তখন যমুনায় তীব্র স্রোত ছিল। মুহূর্তেই কেউ একজন ঝাঁপ দিয়ে দুজনকে বাঁচিয়েছিল।’
মেঘের গলা শুনলে মনে হয়, আমার সাগর কথা বলছে। ফোন করে জানতে চায় দাদির কী প্রয়োজন। অতটুকু ছেলে এখনই বড়দের মতো দায়িত্ববান আচরণ করেসালেহা মনিরের সখেদ উক্তি ‘সেদিনের দুর্ঘটনায় ওকে আর ফিরে না পেলে তো এত স্মৃতি জমা হতো না আমার কাছে। আমার সেই এতটুকু বাচ্চা বড় হলো, চাকরি করল। সীমিত আয়ের সংসারে সামান্য সামান্য করে টাকা জমাল। বিয়ে করল, বাবা হলো। কাজের সূত্রে জাপানে যায়, আমাকে ছবি পাঠায়। ডয়’চে ভেলেতে কাজ করতে গেল জার্মানি। সেখান থেকেও ছবি পাঠাল। সব ছবি জমিয়ে রাখি অ্যালবামে। না দেখলেও সব ছবি মনের মধ্যে উঠে আসে। আমার কাছে তো সেই অতটুকুই আছে আমার সাগর। সেই ছেলেটা মৃত্যুর সময় এত যন্ত্রণা কেমন করে সহ্য করল, মা হয়ে আমি কখনো ভাবতে পারি না।’
ছেলের কথার সূত্রে সালেহা মনির প্রসঙ্গ টানলেন একমাত্র নাতি মাহির সরওয়ার মেঘের। সাগর-রুনির মৃত্যুর সময় মেঘের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। এখন বয়স সাড়ে ১৫। মেঘ মাঝেমধ্যে দাদির সঙ্গে ফোনে কথা বলে। সালেহা মনির বলেন, ‘মেঘের গলা শুনলে মনে হয়, আমার সাগর কথা বলছে। ফোন করে জানতে চায় দাদির কী প্রয়োজন। অতটুকু ছেলে এখনই বড়দের মতো দায়িত্ববান আচরণ করে।’প্রশাসন কি এতই দুর্বল যে ১০ বছরেও বের করতে পারল না খুনির পরিচয়? বিচার নিয়ে আর এখন ভাবি না। শুধু অপরাধী কে, তা যদি জানতাম, সামনে দাঁড়িয়ে একটাই প্রশ্ন করতাম। আমার সন্তানের কী অপরাধ ছিলগুলশানের ডিআইটি স্কুলের ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী মেঘ এখন বিসিবির অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে ক্রিকেট খেলতে যায় বিভিন্ন জেলায়। এ সপ্তাহেই সিরাজগঞ্জে আছে দুটি ম্যাচ। এর মধ্যে একটি ম্যাচ ১১ ফেব্রুয়ারি; এদিন মা-বাবার মৃত্যুদিবস বলে ম্যাচটি খেলছে না মেঘ।
মেহেরুন রুনির ভাই, মেঘের মামা নওশের আলম জানালেন, ‘বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ অনেকটা চাপা স্বভাবের হয়ে উঠছে। গত মাসে ওর নানি মারা যাওয়ার পর সে অসুস্থ হয়ে যায়, কিন্তু কান্নাকাটি করেনি। যত বড় হচ্ছে ওর প্রশ্নের ধরনও বদলাচ্ছে। মা-বাবার হত্যাকাণ্ড, মামলার খবর দেখতে দেখতে মেঘ হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘“ধামাচাপা” শব্দের অর্থ কী?’নবাবপুরে সাগরের যে পৈতৃক বাড়ি, সেটাতে সবার আগে মেঘের অধিকার; বলতে বলতে আবারও চোখে আঁচল দিলেন সাগরের মা। ছেলে ও পুত্রবধূ সাংবাদিক ছিলেন, তাই মা হিসেবে তিনি ভালো করেই জানেন, সাংবাদিকদের লেখা বা সংবাদ প্রচার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের কী মনে হয়, কিছু হবে তদন্তের (সাগর-রুনি হত্যা মামলার)? রুনির মা, নূরণ নাহার আপা তো তদন্ত, বিচার না দেখেই চলে গেলেন। এখন শুধু আমি আছি। আমারও সময় ফুরিয়ে আসছে।’
আবার নিজেই বললেন, প্রশাসন কি এতই দুর্বল যে ১০ বছরেও বের করতে পারল না খুনির পরিচয়? বিচার নিয়ে আর এখন ভাবি না। শুধু অপরাধী কে, তা যদি জানতাম, সামনে দাঁড়িয়ে একটাই প্রশ্ন করতাম। আমার সন্তানের কী অপরাধ ছিল?’কথা বলতে বলতে একসময় বুঝলেন, এই প্রসঙ্গ হয়তো শেষ হবে না তাঁর জীবনে। এই এক দশক সন্তানের কবরের কাছে যাননি সালেহা মনির। এবার হয়তো যাবেন। বললেন, গেলে একমুঠো মাটি দেবেন সন্তানের কবরে। একপর্যায়ে কথা থামিয়ে এই প্রতিবেদককে দেখাতে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছন দিকের সেই সিঁড়িটা। অন্ধকারেও তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চোখ ভরা পানি নিয়ে সাগরের প্রিয় সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মা। এই জায়গায় তাঁর ছেলের স্পর্শ রয়েছে।