রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের বাগ্বিতণ্ডা থেকে শুরু করে হাতাহাতি ও সংঘর্ষের ঘটনা নতুন নয়। মাঝেমধ্যেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারমুখী অবস্থান নেয় দুই পক্ষ। সর্বশেষ সোমবার রাত ও মঙ্গলবার দিনভর সংঘাতের জেরে প্রাণ গেছে নিরীহ তরুণ নাহিদ হোসেনের। এ সংঘাতের জের পড়ে পুরো শহরে; তীব্র যানজটে নাকাল হতে হয় সাধারণ মানুষকে। ঢাকা কলেজের আশপাশে বেশ কয়েকটি বড় বিপণিবিতান (মার্কেট) রয়েছে। নিউমার্কেট ছাড়াও আছে চন্দ্রিমা সুপারমার্কেট, নূরজাহান মার্কেট, চাঁদনী চক শপিং কমপ্লেক্স, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, গ্লোব শপিং সেন্টার ও নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেট।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
নিউমার্কেটসহ আশপাশের বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীদের দাবি, ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয়ে রেস্তোরাঁয় খেয়ে টাকা কম দেওয়া, কাপড়-বই ইত্যাদি কিনে টাকা কম দেওয়া এবং কখনো কখনো টাকা না দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরেই মূলত তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সংঘাত বাধে। অনেক সময় ছাত্রদের একটা অংশ কিছু ব্যবসায়ীর পক্ষে মার্কেটে গিয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে বলে কারও কারও অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের একটা অংশের ভাষ্য, ঈদের মতো বড় উৎসবের আগে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এককালীন মোটা অঙ্কের ‘চাঁদা’ চান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছাত্ররা। এসব নিয়েও সংঘাতের সূত্রপাত হয়।
অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা ও তাঁদের কর্মচারীরা প্রায়ই দুর্ব্যবহার করেন। পণ্যের অতিরিক্ত দাম চান। বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে তাঁরা অশোভন আচরণ করেন। প্রতিবাদ করতে গেলেই তাঁরা মারমুখী হন।
সর্বশেষ সংঘাতের ঘটনায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ মিছিল করে। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীরাও তাঁদের সমর্থন জানান। গতকাল বুধবার ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে মিছিল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীও দোকানমালিক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ করেন ।
ফুটপাতও ভাড়া হয়
নীলক্ষেত মোড় থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত বিভিন্ন বিপণিবিতান ছাড়াও ফুটপাতে হরেক পণ্যের অসংখ্য অস্থায়ী দোকান বসে। অভিযোগ আছে, টাকার বিনিময়ে মানুষের হাঁটার জায়গায় পণ্য নিয়ে বসার সুযোগ করে দেন সাবেক ও বর্তমান ছাত্রনেতার একটা অংশ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, তাঁদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা নেওয়া হয়। ঈদের মতো বড় উৎসবে দিতে হয় এককালীন বড় অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের কাছে ‘উপঢৌকন’ দাবি করেন।
নিউমার্কেট এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন বিপণিবিতানের নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত ফুটপাতের জায়গা অনেক দিন ধরে কতিপয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা আবার তা অন্যদের কাছে ‘ভাড়া’ দেন। দোকানভেদে মাসিক ১০-১৫ হাজার বা এর বেশি টাকায় ফুটপাতের জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়। এই অর্থের একটি অংশ পুলিশ, আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রকদের পকেটে যায়। যেসব দোকানের জায়গা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোতে পুলিশের ‘লাইনম্যান’দেরও নিয়মিত অর্থ দিতে হয়। অর্থ না দিলে দোকান তুলে দেওয়া হয়। ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা ফুটপাতের দখল ধরে রাখতে ছাত্রলীগের বর্তমান নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ূম বলেন, এ ধরনের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। নিউমার্কেট এলাকায় এ ধরনের কিছু ঘটে না।
ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফুয়াদ হাসান বলেন, ‘আমরা ফুটপাতের দোকান নিয়ন্ত্রণ করি, এমন কোনো প্রমাণ ব্যবসায়ীরা দিতে পারলে আমরা যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।’ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনা দীর্ঘদিনের ‘ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেন, ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্রের কারণে তটস্থ থাকতে হয়। নানা ঠুনকো অজুহাতে ব্যবসায়ীদের অপদস্থ করেন তাঁরা। হুমকি–ধমকি, ভাঙচুর, হামলা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখেন।
চাঁদনী চক শপিং কমপ্লেক্সের একটি দোকানের একজন কর্মচারী বলেন, ‘ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয়ে কিছু যুবক প্রায়ই মার্কেটে এসে কাপড় নিয়ে কম দাম দিয়ে চলে যান। প্রতিবাদ করলে তাঁরা আমাদের হুমকি-ধমকি দেন। মাঝেমধ্যে টাকা না দিয়েই পণ্য নিয়ে চলে যান তাঁরা।’ নিউমার্কেটের একটি খাবারের দোকানের কর্মচারী বলেন, ‘দোকানে খেয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয়ে কিছু যুবক বাকির খাতায় লিখে রাখতে বলেন। কিন্তু পরে আর টাকা দেন না।’ নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের একজন মুরগি ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ঢাকা কলেজের ছাত্ররা দুটি মুরগি নিলে একটার দাম দেন।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ব্যবসায়ী ও দোকানমালিক-কর্মচারীদের দিকে। তাঁরা বলছেন, দোকানকর্মীদের দুর্ব্যবহারের কারণে মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। ছাত্ররা কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত নন। ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয় দিলেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের অতিরিক্ত দাম চান। এ নিয়ে কখনো কখনো তর্কাতর্কি হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদেরও অনেকে বলেন, দোকানকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা অনেক দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের সংঘাতে। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা বলেন, এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের সমর্থনে মিছিল করেছেন।
বিনা পয়সায় পণ্য নেওয়া বা রেস্তোরাঁয় খাবার ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, তাঁরা কখনো এমন কাজ করেন না। দু-চারজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা তেমনটা করে থাকতে পারেন বলে জানান তাঁরা।
ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা ফুয়াদ হাসান বলেন, ‘নিউমার্কেটে সপ্তাহে পাঁচ দিন কেনাকাটা করতে এসে এক দিন হেনস্তার শিকার হননি, এমন মানুষ কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ছাত্র বলে বুঝতে পারলেই ব্যবসায়ীরা পণ্যের কয়েক গুণ বেশি দাম চান। কখনো কখনো তাঁরা ক্রেতাদের পণ্যের দাম বলতে বাধ্য করেন। দাম কম বললেই তাঁরা ছাত্রদের নানাভাবে অপমান করেন। এসব নিয়েই ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের ঝামেলাগুলো হয়। কোনো ঝামেলা হলেই ব্যবসায়ীরা বলেন যে ক্রেতারা দাম কম দিয়েছেন বা টাকা না দিয়ে পণ্য নিয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘কিছু ছেলে হয়তো দরদাম নিয়ে মাঝেমধ্যে ঝামেলা করেন। কিন্তু টাকা না দিয়ে ঢাকা কলেজের কেউ পণ্য নিয়ে এসেছেন, এমন উদাহরণ নেই।’
‘অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নেব’
নিউমার্কেটসহ আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর ব্যবসায়ী-দোকানকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম নয়। ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে তাঁদের সংঘাতের ঘটনার সময় ও পরে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন, দোকানিরা ক্রেতাদের পণ্য দেখালেই দাম বলতে বাধ্য করেন এবং দাম না বললে বা ক্রেতার হাঁকা দাম পছন্দ না হলে দুর্ব্যবহার করেন। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নারী ক্রেতাদের উত্ত্যক্ত করারও অভিযোগ করেন কেউ কেউ।
গতকাল দুপুরে ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগের অনেকগুলো স্বীকার করেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মচারীরাও মাঝেমধ্যে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষয়ে আমি একমত। আমরা কথা দিচ্ছি, আগামী ঈদের পরে আমরা তাঁদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করব। আমাদের কর্মচারীরা সুশিক্ষিত নন। কোনো কর্মচারী বেয়াদবি করলে আপনারা সমিতির কার্যালয়ে অভিযোগ জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব।’