‘বাংলাদেশকে আমরা অনেক ওপরে দেখতে চাই। অনেক, অনেক সুযোগ আছে বাংলাদেশের। আমরা নারী–পুরুষ মিলে অনেক ওপরে যাব।’আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে এমন আশাজাগানিয়া কথা শোনালেন র্যামন ম্যাগসাইসাই বিজয়ী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী। তিনি আজ মঙ্গলবার কার্যালয়ে তাঁকে দেওয়া সম্মাননা অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ৮ মার্চ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । এবারের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এই জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী। অনুষ্ঠানে ফেরদৌসী কাদরীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। সেখানে আরেক ম্যাগসাইসাই বিজয়ী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকেও সম্মাননা দেওয়া হয় । দুজনের মধ্যে ফেরদৌসী কাদরী ২০২১ সালে এবং ২০১২ সালে ম্যাগসাইসাই পান। এ দুজনসহ ১২ জন বাংলাদেশি ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে চারজন নারী। অন্য দুজন হলেন তহুরুন্নেসা আবদুল্লাহ ও অ্যাঞ্জেলা গোমেজ।
ফেরদৌসী কাদরী ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আরেক ম্যাগসাইসাই বিজয়ী, সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি ম্যাগসাইসাই পান ২০০৫ সালে।আজ বেলা তিনটায় কার্যালয়ে নারী দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এখানে প্রতিষ্ঠানের সব নারী কর্মী অংশ নেন। ঘরোয়া আয়োজন, কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রত্যেক নারী কর্মীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি যখন ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন তখন অনুষ্ঠানমঞ্চে কর্মী আরাফাত করিম একে একে গেয়ে শোনাচ্ছিলেন অর্থহীন ব্যান্ডের সুমনের ‘আমার প্রতিচ্ছিবি’, তাহসানের ‘আলো’।আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আজকের নারী–পুরুষে সমতা : টেকসই আগামীর বার্তা।’ প্রধান অতিথির আগমনের পরে শুরুতেই কর্মীরা সমবেত কণ্ঠে গাইলেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ ও ‘আগুনের পরশমণি’।
আজই পাঁচ কৃতী নারীকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেগুলো তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানের শুরুতে। সেই নারীরা হলেন জলবায়ুবিষয়ক ছয় বিজ্ঞানীর একজন গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী, কোলোরেক্টাল সার্জন ইসমাত জাহান, মার্কিন সরকারের উদ্ভাবন বিশেষজ্ঞ আওয়ালিন সোপান, কারাতে প্রশিক্ষক মারুফা খাতুন, অনলাইনে ইংরেজি শিক্ষাদানকারী মুনজেরিন শহীদ।
কলেরার টিকা নিয়ে গবেষণা ও সাশ্রয়ী দামে টিকা সহজলভ্য করে লাখো প্রাণ রক্ষায় কাজ করেছেন ফেরদৌসী কাদরী। ম্যাগসাইসাই পুরস্কার ঘোষণার সময় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘লাখো মানুষের উপকারে টিকার উন্নয়নে তাঁর নিবেদিত ভূমিকার জন্য’ এই পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে। আর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে ম্যাগসাইসাই দেওয়ার সময় বলা হয় ‘পরিবেশ ও জীবনের রক্ষা সমার্থক। আর এটি প্রতিষ্ঠায় আপসহীন অবস্থানের জন্য’ তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
আজ শুরুর বক্তব্যে সম্পাদক মতিউর রহমান দুই কৃতী নারীর অবদানকে স্মরণ করেন। নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে দুজনের অসামান্য অবদানের কথা তুলে ধরেন তিনি। অধ্যাপক ফেরদৌসী কাদরীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মতিউর রহমান বলেন, ‘তিনি বিজ্ঞান গবেষণার জটিল কাজ করেছেন। সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন গবেষণায়। আর তাঁর অবদান এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি বাংলাদেশকে মহিমান্বিত করেছে।’
রিজওয়ানা হাসানকে উদ্দেশ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘ভয়ংকর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে চলেছেন আপনি। সেই সক্ষমতাকে সম্মান জানাই।’নারীর অধিকারের সপক্ষে দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার কথাই তুলে ধরি না। সমস্যা ও সংকটের পাশাপাশি দেশে–বিদেশে নারীর যত অর্জন, সক্ষমতা—সবই আমরা তুলে ধরি। আমাদের প্রতিনিয়ত নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সবকিছুর পরও নারীর পাশে সাধ্যমতো থাকার চেষ্টা করেছি। সব ভালো কাজের সঙ্গে থেকেছি।’
দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি বলেও মন্তব্য করেন মতিউর রহমান।নিজের বক্তব্যে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নিজের পরিবারের মতোই মনে করি। পরিবারের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া তাই অনেক বেশি সম্মানের, আনন্দের।’নিজের কাজ নিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমি পরিবেশগত ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করি। প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে সোচ্চার। দুটোই বড় ধরনের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। তাই উভয়ের কাজের মধ্যেই সাযুজ্য আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু সংবাদপত্রকে নয়, আমাদের সবাইকেই স্পর্শ করে।’রিজওয়ানা হাসান বলেন, জেন্ডার ন্যায়বিচারের সঙ্গে পরিবেশগত ন্যায়বিচারের নিবিড় সংযোগ আছে। আধিপত্যবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিকাতর বিরুদ্ধে যেমন লড়াই আছে, তেমনি আমাদেরও লড়াই আছে।’
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কথা বলেন ফেরদৌসী কাদরী। তিনি বলেন, আমার পছন্দের পত্রিকা। এখান থেকে অনেক কিছু শিখি। এখানে ছাপানো সাহসের অনেক কথা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।’নিজের কাজের ধারাবাহিকতা নিয়ে অধ্যাপক কাদরী বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। কিন্তু আমি সব সময় গবেষণা করতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্ল্যাটফর্ম ছিল না । আমি অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম। আইসিডিডিআরবির প্ল্যাটফর্ম পেয়ে আমি বড় একটা কিছু পেলাম। এই প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের অনেক নারী ও পুরুষকে অনেক কিছু দিয়েছে। একে আমি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলি না। এটা সত্যিকারের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।’
ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘সারা জীবন কাজ করেছি ল্যাবের ভেতরে। একসময় মনে হলো, ল্যবের ভেতরে থাকলে মানুষের জন্য কিছু তো করছি না। ২০০৫ থেকে আমার চিন্তাধারায় পরিবর্তন এল। ভাবলাম, বাংলাদেশে কেন আমরা কিছু করতে পারি না।একটি টিকা তৈরি হবে, সেটা শুনব বিদেশে তৈরি হবে। আবার সেটি চলে যাবে আফ্রিকায়। টিকা বাংলাদেশে কেন তৈরি হবে না। আমি তৈরি করিনি, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকা তৈরি করছে। এভাবে টাইফয়েডের টিকা নিয়েই কাজ করেছি।ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘আমি কিন্তু টিকা বানাই না। আমি কলেরার রোগী নিয়ে গবেষণা করেছি। রোগের ফলে তার কী কী পরিবর্তন হয়, সেসব নিয়ে গবেষণা করেছি। আর একের পর এক টিকার ট্রায়াল করেছি বাংলাদেশে। এটাকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য আমরা কাজ করেছি। ২০০৭ সালে মুখে খাওয়া কলেরার টিকার প্রসার শুরু হয়েছে।’
নিজের কাজের পেছনে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের অবদানের কথা আজও স্মরণ করেন ফেরদৌসী কাদরী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাকে সবকিছুর জন্য উৎসাহ দেয়। আমি বাংলাদেশে না থাকলে হয়তো কিছুই করতাম না। বিদেশের ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ পোস্টডক্টরাল হিসেবে থাকতাম।’আশার কথা ছড়িয়ে দেন বিশ্বের নানা পুরস্কারে ভূষিত বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এত রকমের সমস্যা। আমরা যদি সবাই একেক দিকে লক্ষ্য নির্দিষ্ট করি তাহলে কিছু কিছু না কিছু করতে পারব। আমাদের অনেক কিছু করার আছে।’দেশে চলমান করোনার টিকার প্রসারের কথা স্মরণ করেন ফেরদৌসী কাদরী। তিনি বলেন, কোভিডের টিকার যে সাফল্য বাংলাদেশের, তা পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই নেই। ১৩ কোটি মানুষ টিকা পেয়েছে। এটা সহজ কথা নয়।’আজকের অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইনজীবী মিতি সানজানা, চিকিৎসক ইসমাত জাহান, কলাম লেখক আফসানা বেগম, মাহা মির্জা, লায়লা খন্দকার ও নিশাত সুলতানা।