খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুই কোটি জনসংখ্যার ধাপ পেরিয়ে এখন বিশ্বের ষষ্ঠ জনসংখ্যাবহুল রাজধানী শহর হয়ে উঠেছে ঢাকা। কারও মতে, এই শহরের বয়স ৪০০ বছর, আবার সাম্প্রতিক হিসাবে তা প্রায় এক হাজার বছর। দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থান আর চারপাশে নদ–নদী থাকায় ঢাকা ছিল স্বাস্থ্যকর এলাকা। তবে গত কয়েক যুগে এই শহরের সবুজ এলাকা ও জলাভূমি হারিয়েছে, আর বাতাস–মাটি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। গত এক বছরে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে কয়টি জরিপ হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিচে নেমেছে।
*কম বসবাসের যোগ্যতা ও বায়ুদূষণে দ্বিতীয়। * জনসংখ্যা ও কম নিরাপত্তায় ষষ্ঠ। * যানজটে নবম। * উদ্ভাবনে ৫০০ শহরের মধ্যে ৪৪৯তম। * ৩০ বছরে সবুজ এলাকা ১৭ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নেমেছে।
ঢাকা শহর নিয়ে সম্প্রতি করা কয়েকটি গবেষণায়ও বসবাসের জায়গা হিসেবে ঢাকার এই অবনতি ধরা পড়েছে। এসব গবেষণায় ঢাকায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নগর ব্যবস্থাপনায় নানা সমস্যা উঠে এসেছে। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা আর বায়ু–মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এই সবগুলো ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। মাত্র ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহর নিয়ে চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালেও ঢাকা শহরের ১৭ শতাংশ এলাকা ছিল সবুজ গাছপালায় ঘেরা। বিশ্বের স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর পরিবেশের শহরগুলোতে এই বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু ২০২০ সালে অর্থাৎ মাত্র ৩০ বছরে তা মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলত ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার সবুজ ও জলাভূমি এলাকা সবচেয়ে দ্রুত হারে কমেছে। শহরের নতুন আবাসিক এলাকাগুলোতে কিছু কিছু গাছপালা বাড়লেও তা সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় খুবই কম। জনসংখ্যার ব্যাপক চাপ ও শহর ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা ও সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এই শহরের সামগ্রিক পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে।এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ বৈশ্বিক সূচকে ঢাকার অবস্থানের অবনতি হয়েছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত, এই শহরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু যাঁরা এই শহরে নতুন করে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দরিদ্র। ফলে তাঁরা আর্থিক কারণে শহরে নিজেরা নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না। আবার নগরের সামগ্রিক পরিবেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এই শহরকে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় আনার জন্য একের পর এক পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু তার বেশির ভাগের কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে শহরের সামগ্রিক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের অবনতি হচ্ছে।
বসবাসযোগ্যতায় অবনতি
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে বিশ্বের কোন শহর বসবাসের জন্য কেমন, তা বুঝতে জরিপ করা হয়েছে। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বের বসবাসের কম অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার নাম একটুর জন্য শীর্ষ স্থানে উঠতে পারেনি। সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দামেস্ক ওই তালিকায় সবার ওপরে, তার পরেই ঢাকার অবস্থান। এরপর একই সংস্থা গত ২০ সেপ্টেম্বর বসবাসের জন্য নিরাপদ শহরের যে তালিকা করে তাতেও ঢাকা ৬০টি শহরের মধ্যে ৫৪তম অবস্থানে ছিল।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিইউপি) থেকে গত বছর ঢাকার এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্ব নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বের একটি স্বাস্থ্যকর শহরের প্রতি একর এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ জন নাগরিকের বসবাস করা উচিত। এটা সর্বোচ্চ ১২০ জন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ঢাকার এক–তৃতীয়াংশ এলাকায় তা ৭০০ থেকে ৮০০ জন। লালবাগ, সবুজবাগ, গেন্ডারিয়াসহ পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় এই সংখ্যায় মানুষ বসবাস করে। আর সামগ্রিকভাবে তা ৩০০ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর জাপানের টোকিওতে মোট ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস করে। কিন্তু সেখানে প্রতি একরে ৯০ জনের কম মানুষ বাস করে। সিঙ্গাপুরের মতো বহুতল ভবনসমৃদ্ধ শহরে তা ৮০ জন, সিডনিতে ৫৮ জন ও নিউইয়র্কে ১১২ জন।
বসতিবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন হ্যাবিটেট–এর হিসাবে, একটি আদর্শ বড় শহরের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলাকা সবুজ, ১৫ শতাংশ এলাকা জলাভূমি থাকতে হবে। আর সড়ক থাকতে হবে ২০ শতাংশ এলাকায়। ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র ৮ শতাংশ এলাকাজুড়ে। আর উন্মুক্ত স্থান আছে মাত্র শহরের ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। ফলে এখানে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে ঢাকার মোট আয়তনের ৮২ শতাংশ এখন কংক্রিটের ভবন আর পিচঢালা সড়কে ভরা। আর বিশ্বের বেশির ভাগ বড় শহরের তুলনায় এটা প্রায় দ্বিগুণ।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সরকারি নথিতে রাজধানীর যেসব এলাকা সবুজ ও জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত ছিল, তা একের পর এক দখল হচ্ছে। খাল, নদী, লেক ও উদ্যানের এসব জমি দখলমুক্ত করে নাগরিকের ব্যবহারের জন্য ফিরিয়ে দিলেও ঢাকা বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে কিছুটা উন্নতি হবে। ন্যূনতম এই কাজটুকু জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত।
বায়ুদূষণের পালাবদল, দ্বিতীয় স্থান অপরিবর্তিত
এ তো গেল বসবাসের যোগ্যতার দিক থেকে ঢাকার অবস্থান। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ এখন অন্যতম সমস্যা। কয়েক বছর ধরে ঢাকা সবচেয়ে দূষিত বাতাসের পাঁচটি শহরের মধ্যে রয়েছে। তবে চলতি বছর বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক নম্বর হয়েছে। আর শহরের তালিকায় দিল্লির পরেই রয়েছে ঢাকার নাম। এর আগের বছরও ঢাকা এই অবস্থানে ছিল।সংস্থাটির হিসাবে ঢাকার বায়ু বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনের চেয়েও বেশি সময়জুড়ে অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। এটা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। ২৮ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ঢাকা শহর বায়ুদূষণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, তাঁরা এই শহরের সমস্যাগুলো একে একে সমাধান করছেন। দূষণ রোধ ও নাগরিক সুবিধা বাড়াতে যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এসব কাজ শেষ করতে পারলে দ্রুত বসবাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার উন্নতি হবে।ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে চলতি বছর প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক জরিপ বলছে, রাজধানীর বাতাসকে এখন বিষিয়ে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ুদূষণের অর্ধেক (৫০%) দায়ই মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়ার। ৪০ ভাগ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। বাকি ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে।থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎসের একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকে মনে করা হতো। কিন্তু এই জরিপ বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটার স্থান দখল করেছে যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া।
বায়ুদূষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও বায়ু মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান অধ্যাপক আবদুস সালামের নেতৃত্বে করা এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাতাসে এই সব কটি সূক্ষ্ম বস্তুকণা মিলে তৈরি করছে কালো কার্বন, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই কালো কার্বন বছরের অর্ধেকের বেশি সময়জুড়ে রাজধানীসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোয় চলা অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতকাজের কারণে প্রচুর ধুলার সৃষ্টি হচ্ছে। কালো কার্বন ওই ধুলায় ভর করে উন্মুক্ত স্থানের পাশাপাশি বাড়িঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই ঘরের ভেতরে থাকলেও নিশ্বাসের সঙ্গে তা শরীরে ঢুকে পড়ছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক সালাম বলেন, শুধু অবৈধ ইটভাটাগুলো ভেঙে দিলে বায়ুদূষণ কমবে না। ঢাকার যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর। আর ধোঁয়া ও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশনগুলো থেকে নিয়মিত তদারকি এবং রাস্তায় পানি ছিটানোর কাজ করলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু এই নিয়মিত কাজটিও ঠিকমতো না করায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতির বেশি অবনতি হচ্ছে।মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি থেকে বের হওয়া ধোঁয়া ও যানজট ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর যানজটের অবস্থা নিয়ে নামবিও নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতি ছয় মাস পরপর এবং বছরে একটি জরিপ ফলাফল প্রকাশ করে। ওই জরিপে সবচেয়ে বেশি যানজটের শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ২০২১ সালে ছিল নবম। সবচেয়ে খারাপ অবস্থার শহরগুলো হলো নাইজেরিয়ার লাগোস, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও কোস্টারিকার স্যান জোস। বিশ্বের ২৫০টি শহরের ওই তালিকায় সবচেয়ে কম যানজটের শহরের শীর্ষে রয়েছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ডের বাসেল, রোমানিয়ার ব্রাসোভ ও সার্বিয়ার নোভি সাদ।
সৃজনশীলতায়ও তলানিতে
একটি শহরের পরিবেশ, সেবা ও বসবাসযোগ্যতার নিরিখে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ইনোভেশন এজেন্সি ২০০৬ সাল থেকে একটি বৈশ্বিক সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে কোনো শহরের মানুষ ও সংস্থাগুলো কত বেশি উদ্ভাবন করে থাকে, তার প্রেক্ষিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। বিশ্বের ৫০০টি শহরের পরিস্থিতি নিয়ে ২০২১ সালে প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে এক নম্বর স্থান নিয়েছে জাপানের টোকিও। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও নিউইয়র্ক শহরের নাম রয়েছে। প্রথম ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান নেই। গত এক বছরে চার ধাপ পিছিয়ে ২০২১ সালে ঢাকার অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৪৪৯তম।এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঢাকা ছিল বিশ্বের অন্যতম সুন্দর পরিবেশের শহর। বিশ্বের অন্যতম সেরা উদ্ভাবনগুলো হতো এই শহরকে কেন্দ্র করে। মসলিন, জামদানি থেকে শুরু করে মৃৎশিল্পের অন্যতম বড় বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এই শহর। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শহরের সামগ্রিক পরিবেশের দ্রুত অবনতি হয়েছে। ঢাকা শহর এখন প্রায় ‘লাইফসাপোর্টে’ চলে গেছে। এর দ্রুত ও জরুরি চিকিৎসা করতে হলে চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে।