মো. জামাল উদ্দিনের সোনালী ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক লাখ টাকা জমা দেন একজন নার্সের নিকটাত্মীয়। ওই দিনই এই নার্সকে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলির আদেশ হয়। দুই দিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর একই জমাদানকারীর মাধ্যমে আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা পড়ে ওই একই হিসাবে।নার্সরা নিজেদের পছন্দের জায়গায় সহজে বদলি হতে পারেন না। বদলির জন্য আবেদন করে দিনের পর দিন রাজধানীর মহাখালীর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে তদবির করতে হয়। সব সময় কাজ হয় না। কিন্তু টাকা দিলে দু-এক দিনের মধ্যেই বদলি নিশ্চিত। টাকার পরিমাণ দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ।
এত দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা শুনে এসেছি। এখন নতুন করে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা শুনতে হচ্ছে। এটা নিন্দনীয়, দুর্ভাগ্যজনক। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বদলি হওয়ার জন্য নার্সরা টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মধ্যস্থতাকারী বা দালালেরা নার্সদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। টাকা লেনদেন হওয়ার পর অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নার্সদের বদলি করছেন। চারজন নার্সের বদলির আদেশ, একজন মধ্যস্থতাকারীর দুটি ব্যাংকের হিসাব, নার্স ও মধ্যস্থতাকারীর আলাপের সূত্র থেকে এই দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়েছে।নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার বলেছেন, নার্স বদলিতে অনিয়ম-দুর্নীতি হয় না। ৯ জানুয়ারি নিজ কার্যালয়ে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, কোনো দালাল টাকা নিলে অথবা কোনো নার্স বদলির জন্য কোনো দালালকে টাকা দিলে অধিদপ্তর কী করে জানবে? টাকা নিয়ে বদলির সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত নন।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর জামাল উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে কক্সবাজার, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, সৈয়দপুর, দিনাজপুর থেকে মোট ১৫ বার টাকা জমা হয়েছে। সর্বনিম্ন ৫৯ হাজার ৪২ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা হয়।মহাপরিচালক বলেছেন, প্রতিদিনই কিছু নার্স বদলি হয়। অন্যদিকে নার্সদের একটি সূত্র বলছে, গত বছরের শেষ আট মাসে প্রায় আড়াই হাজার নার্সের বদলি হয়েছে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেছেন, তাঁরা বেতন পান ৩০ হাজার টাকার মতো। বদলি হতে সাত-আট মাসের বেতন দিয়ে দিতে হয়।
চিকিৎসক ও নার্স একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় যুক্ত। নার্সদের বদলিবাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এত দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা শুনে এসেছি। এখন নতুন করে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা শুনতে হচ্ছে। এটা নিন্দনীয়, দুর্ভাগ্যজনক। এটা চলতে থাকলে মানুষ স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর থেকে পুরোপুরি আস্থা হারাবে। মন্ত্রণালয়ের উচিত এখনই ব্যবস্থা নেওয়া।’
ফেলো কড়ি, মাখো তেল
নার্স ও অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, একজন নার্স হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বদলি হয়ে নিজের জেলা দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে। বদলির তদবির করতে তিনি কর্মস্থল থেকে পাঁচবার ঢাকায় এসেছিলেন। কাজ হয়নি। কাজ হয়েছে মো. জামাল উদ্দিনের সোনালী ব্যাংকের হিসাবে টাকা দিয়ে। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে দুই কিস্তিতে এই টাকা দেওয়া হয়েছিল। এখন তিনি দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করছেন।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এটা হতে পারে না। এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা দালালদের চেয়েও বেশি অপরাধী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত দালালের সূত্র ধরে অধিকতর অনুসন্ধান করা, জড়িতদের শনাক্ত করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া।মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে ফোন ধরেন নার্সের স্বামী। তিনি বলেন, বদলির জন্য তাঁরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু টাকা লেনদেনের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।এর আগে ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে একজন নার্সকে দিনাজপুর এম আবদুর রহীম মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। এর দুই দিন পর ওই নার্স দেড় লাখ টাকা মো. জামাল উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। ওই নার্স টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তিনি নিজে তো কোনো অভিযোগ করেননি, তাহলে বিষয়টি সাংবাদিক কেন অনুসন্ধান করবেন?
তবে এক লাখ টাকা দিয়েও এখনো বদলি হতে পারেনি একজন নার্স, এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। টাকা জমার রসিদে দেখা গেছে, মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজের আইএফআইসি ব্যাংকের হিসাবে একজন নার্স গত ৬ ডিসেম্বর এক লাখ টাকা জমা দেন। এই নার্স শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কর্মরত। নার্সরা জানিয়েছেন, মো. জামাল উদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জামাল এন্টারপ্রাইজ।দেশে প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের ঘাটতি আছে। কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহজে নার্সদের ছাড়তে চায় না। অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তার মতো নার্সরাও নিজেদের জেলায় বা উপজেলায় কাজ করতে আগ্রহ দেখান। তাই ঘুষ দিয়ে হলেও তাঁরা বদলি করিয়ে নেন। নার্সদের একটি সংগঠনের নেতা বলেন, গত ৮-১০ মাসে অন্য জেলা থেকে বদলি হয়ে টাঙ্গাইল জেলায় যাওয়া প্রত্যেক নার্সকে বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়েছে।
টাঙ্গাইলে বাড়ি, এমন একজন নার্স কাজ করতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনিও ৯ আগস্ট দুই লাখ টাকা জামাল উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল থেকে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁর বদলি হয়। ৭ সেপ্টেম্বর আরও একজন নার্সকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে বদলি করা হয়। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর ওই নার্স জামাল উদ্দিনের একই ব্যাংক হিসাবে আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলেন।
তবে এক লাখ টাকা দিয়েও এখনো বদলি হতে পারেনি একজন নার্স, এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। টাকা জমার রসিদে দেখা গেছে, মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজের আইএফআইসি ব্যাংকের হিসাবে একজন নার্স গত ৬ ডিসেম্বর এক লাখ টাকা জমা দেন। এই নার্স শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কর্মরত। নার্সরা জানিয়েছেন, মো. জামাল উদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জামাল এন্টারপ্রাইজ।জামাল উদ্দিন ওই নার্সকে বলেছিলেন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কানাডা যাওয়ার কথা আছে। কানাডা থেকে ফিরলে বদলি হবে। মহাপরিচালক কানাডায় যাননি। তবে বদলিও হয়নি।ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর জামাল উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে কক্সবাজার, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, সৈয়দপুর, দিনাজপুর থেকে মোট ১৫ বার টাকা জমা হয়েছে। সর্বনিম্ন ৫৯ হাজার ৪২ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা হয়।
রেট ২,২০,০০০ টাকা
জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একজন নার্স তাঁর বোনের বদলির জন্য যোগাযোগ করেছিলেন মো. জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, বদলির রেট ২ লাখ ২০ হাজার টাকা।ওই নার্স বলেন, বোনের বদলির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে জামাল উদ্দিনের কমপক্ষে দুবার কথা হয়েছে। কীভাবে বদলি হবে, বদলি করতে কত টাকা দিতে হবে, কীভাবে টিকা দিতে হবে, কোথায় টাকা দিতে হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। তখন জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, ‘২ লাখ ২০ হাজার লাগবে, বোন। যদি হয় আমাকে জানাবেন।’নার্সদের কাছ থেকে মো. জামাল উদ্দিনের চারটি মুঠোফোন নম্বর পাওয়া গেছে। নার্সরা এসব নম্বরে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময় যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু গত দুই দিনে এসব নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
কে এই জামাল উদ্দিন
মো. জামাল উদ্দিনের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের দুধকুমড়া গ্রামে। এলাকায় তাঁর সুনাম নেই। বরং ঠক-বাটপার হিসেবেই পরিচিত বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একজন বলেছেন, ‘আমরা কেউ জানি না ও কত দূর লেখাপড়া করেছে। ও ঠিক কী করে, জানি না। তবে ভালো কিছু যে করে না, তা নিশ্চিত বলা যায়।’তবে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের অনেকেই তাঁকে চেনেন। চেনেন না শুধু অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার। এই প্রতিবেদক মো. জামাল উদ্দিনের ছবি দেখালে সিদ্দিকা আক্তার বলেন, তিনি তাঁকে চেনেন না, কোনো দিন দেখেননি।
কিন্তু অধিদপ্তরের অনেকেই তো তাঁকে চেনেন, এমন কথার পিঠে সিদ্দিকা আক্তার বলেন, অধিদপ্তরে অনেক মানুষই আসে। সবার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় না।সাধারণ নার্স ও নার্স নেতারা বলেছেন, জামাল উদ্দিন একা নন, তাঁর মতো একাধিক ব্যক্তি বদলিবাণিজ্য করছেন। অধিদপ্তরের বদলির কাজে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে জামাল উদ্দিনদের সম্পর্ক রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ নিজ খরচায় উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিলেত গেছেন, কেউ কেউ খুব শিগগির যাবেন।এ ব্যাপারে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এটা হতে পারে না। এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা দালালদের চেয়েও বেশি অপরাধী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত দালালের সূত্র ধরে অধিকতর অনুসন্ধান করা, জড়িতদের শনাক্ত করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া।