বর্তমানে মানুষের অন্যতম পছন্দে পরিণত হয়েছে ফাস্ট ফুড। সব জায়গায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ফাস্ট ফুডের দোকান ও ফাস্ট ফুড চেইন। ফাস্ট ফুড সহজেই পাওয়া যায়, অনেক সময় হোম ডেলিভারিও দেওয়া হয়, খেতেও বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু সুস্বাদু বার্গার, ফ্রাই আর ঠান্ডা পানীয়ের পেছনে লুকিয়ে আছে বিপদের আবছায়া। আমরা এই লেখায় দেখব যে ফাস্ট ফুড আমাদের দেহ এবং মানসিক সুস্বাস্থ্যের ওপর কেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব নেতিবাচক প্রভাব বুঝতে পারার দ্বারা আমরা নিজেদের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে আরো সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হব।
বলা হয়ে থাকে, ফাস্ট ফুড খেলে মানুষ মোটা, স্টুপিড আর কুৎসিত বানায়।
কিন্তু কেন?
আসুন, ফাস্ট ফুড ও প্রসেসড ফুডের ১০টি নেতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলা যাক।
ব্রণ
ফাস্ট ফুডে প্রায়ই অ্যাডেড সুগার এবং প্রচুর খালি কার্বোহাইড্রেট থাকে। অ্যাডেড সুগারের ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় এবং তাই ইনসুলিনের মাত্রাও বেড়ে যায়। এটা IGF-1 এর মতো হরমোনকে প্রভাবিত করে। এই হরমোনটি দ্রুত কোষ বিভাজন, তৈলাক্ত ত্বক এবং ব্রণ তৈরির জন্য দায়ী।
ওজন বৃদ্ধি
অবশ্যই, ফাস্ট ফুড খেলে আপনার ওজনও বেড়ে যাবে। কারণ ফাস্ট ফুডে অনেক ক্যালোরি থাকে যা আপনার দেহ কাজে লাগাতে পারে না, ফলে এটা চর্বি আকারে আপনার দেহে জমা হয়। ফ্রুক্টোজ বিভিন্ন সফট ড্রিংকে সুইটেনার বা মিষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয়, এটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এটা অন্যান্য ধরণের সুগার যেমন গ্লুকোজের চেয়ে অনেক দ্রুত ফ্যাটে পরিণত হয়।
পেট ফুলে যাওয়া
ফাস্ট ফুডে সোডিয়ামের উপস্থিতি এক বিশাল সমস্যা। বার্গারের প্যাটিতে অনেক লবণ দেওয়া হয়। বার্গারের উপরের অংশেও অনেক লবণ থাকে। যখন লবণ দেওয়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের সাথে বার্গার খান তখন কি পরিমাণ সোডিয়াম আপনার দেহে প্রবেশ করে চিন্তা করুন। ফলে শরীরের সহনশীলতার মাত্রার চেয়েও অধিক লবণ খাওয়া হয়ে যায়। এতে ফ্লুইড রিটেনশন হয় অর্থাৎ দেহের কোনো জায়গায় পানি জমে যাওয়ার কারণে জায়গাটা ফুলে যায়। এতে হজম হয় না সঠিকভাবে। পেটে গ্যাস হয়। তখন মনে হয় আপনি বেলুনের মতো ফুলে গেছেন।
ফোলা
খুব বেশি সোডিয়াম গ্রহণের একটি সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো হাত, বাহু এবং পায়ের মতো জায়গা ফুলে যাওয়া। আমাদের শরীর সবসময় সোডিয়াম এবং তরলের মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখতে চায়। আপনি যদি অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ করেন, তাহলে কোষ থেকে পানি বের হয়ে যাবে, রক্তের প্রবাহে প্রবেশ করবে এবং আপনার হাত-পা ফুলে যাবে।
উচ্চ কোলেস্টেরল
ফাস্ট ফুড, বিশেষ করে ভাজা খাবারে প্রচুর ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিনের (এলডিএল) মাধ্যমে রক্তে সঞ্চালিত হয় । ধমনীতে এলডিএল পরিবর্তনের মাধ্যমে আন্তঃকোষীয় লিপিড জমা হতে পারে, যার ফলে প্লাক গঠিত হতে পারে। এর ফলে স্ট্রোক বা অন্যান্য হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মানসিক চাপ
গবেষণায় দেখা যায় যে, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য আপনার মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে। কারণ এটি আপনার স্মৃতিকে দুর্বল করে দেয়। এবং শুধু তাই নয়, এটি ডিমেনশিয়া, দ্রুত মেজাজ পরিবর্তন, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। আপনার বিষণ্নতায় পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে ফাস্ট ফুড বেশি খেলে বিষণ্নতা এবং অ্যানজাইটির ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদিও এই খাবারগুলো সাময়িক আনন্দ দিতে পারে তবে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আমাদের মেজাজ এবং সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। উপরন্তু, ফাস্ট ফুডে অ্যাডিটিভ এবং প্রিজারভেটিভের অত্যধিক ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিকের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, আমাদের মানসিক স্থিতিশীলতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
হরমোন নিঃসরণ এবং হরমোন নিঃসরণে বাধার কারণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়। যেমন স্বল্পস্থায়ী ডোপামিন নিঃসরণ, কর্টিসল নিঃসরণ এবং টেস্টোস্টেরন মাত্রা কমে যায়।
পুষ্টির ঘাটতি
হাই ক্যালোরি এবং ফাস্ট ফুডে কম পুষ্টি উপাদান থাকে। এর মানে হল, আপনি আসলে অনেক খেলেও কিন্তু তেমন কিছুই খাচ্ছেন না। এটাকে বলা হয়য় “খালি ক্যালোরি”। প্রচুর খেয়েও কোনো পুষ্টি পাচ্ছেন না আপনি। মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরবৃত্তীয়ভাবে কাজ করার জন্য আপনার ভিটামিন এবং খনিজ প্রয়োজন। দেখা গেছে যে যারা এক মাস ধরে শুধু ফাস্ট ফুড খেয়েছিল তারা পুষ্টির অভাবের কারণে প্রায় মারা গেছে!
বাজে ফিটনেস
আপনি যদি পেশি বা শক্তি বাড়াতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে বলার দরকার নেই যে ফাস্ট ফুড আপনাকে কখনোই সুষম ফ্যাট-প্রোটিন অনুপাত দিতে পারবে না। ফাস্ট ফুডে যেহেতু পুষ্টি থাকে না, তাই পেশি গড়ার মতো অ্যামিনো এসিড বা প্রোটিন এখানে থাকবে না। বরং, আপনার টেস্টোস্টেরনও কম নিঃসৃত হবে। টেস্টোস্টেরনের কাজ হচ্ছে আপনার পেশি গঠনে সহায়তা করা এবং ব্যায়াম করার মোটিভেশন পাওয়া।
ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়
এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে প্রক্রিয়াজাত খাবার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে কোলন ক্যান্সার। আমরা পিত্ত অ্যাসিডের মাধ্যমে চর্বি গ্রহণ করি, যা ফ্যাটি অ্যাসিডের সাথে যুক্ত হয় এবং সেগুলোকে আরও দ্রবণীয় করে তোলে। আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া পিত্ত অ্যাসিড থেকে গ্লাইসিন এবং টরিনকে সরিয়ে দেয়, যেখানে লিথোকোলিক অ্যাসিডের মতো সেকেন্ডারি পিত্ত অ্যাসিড তৈরি হয় এবং এগুলি কার্সিনোজেনিক বা ক্যান্সার তৈরীকারী।
দাঁত নষ্ট হওয়া
অ্যাডেড সুগার এবং পুষ্টির ঘাটতির কারণে দাঁতের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত গরুর গোশত মুখের ভেতর এসিড তৈরী করে। এর কারণে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি এবং দাঁতের ক্ষতি হয়।
এ ছাড়া বোনাস হিসেবে আরেকটা পয়েন্ট শেয়ার করা যাকঃ
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগজীবাণু বা সংক্রমণের সাথে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখায় একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় প্রক্রিয়াজাত খাবারের সাথে অর্থাৎ ফাস্ট ফুডের সাথে। ফলে আপনার ভেতর অসুস্থ হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। আসল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
ফাস্ট ফুড বেশ লোভনীয় হতে পারে এবং সহজেই অল্প দামে এটি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের শরীর এবং সুস্থতার উপর এর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব আছে। স্থূলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং হজমের উপর প্রভাব ফেলে। নিয়মিত ফাস্ট ফুড খাওয়ার বাজে পরিণতি অনস্বীকার্য। তাই আমাদের স্বাস্থ্যকর খাবারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ফাস্ট ফুডের উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে সচেতন হতে হবে। এভাবে আমরা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারব এবং একটি উন্নতমানের জীবন উপভোগ করতে পারব।
আপনি সেগুলো চাইলে জানাতে পারেন মন্তব্যের ঘরে। লেখাটি কেমন লাগল সেটিও জানাতে ভুলবেন না যেন।