বাংলাদেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপি প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ও তাঁর সহযোগীদের হেফাজতে নিয়ে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ভারতীয় কর্তপক্ষ।
প্রথম দিনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রবিবার এক বিবৃতি দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তাকে আরও ২ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, পি কে হালদারের আত্মসাৎ করা অর্থের একটা বড় অংশ এখনো দুবাইয়ে রয়েছে। হুন্ডির নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দুবাই ও পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই অর্থ পাঠানো হয়েছে।
কলকাতার নগর আদালত শনিবার রাতে পিকে হালদারসহ পাঁচ পুরুষকে ইডির হেফাজতে দেন। আর একজন নারীকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। কলকাতা থেকে পি কে হালদারকে গতকাল গ্রেপ্তার করে ইডির। পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নামে–বেনামে থাকা তাঁর বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানেও অভিযান চালিয়ে আরও পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন ইডির তদন্ত কর্মকর্তারা।
ইডি জানিয়েছে, দুর্নীতি বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে পি কে হালদার দুবাইয়ে পালিয়ে যান। ২০১৯ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসেন এবং তার প্রধান সহযোগী সুকুমার মৃধার সঙ্গে মাছের ঘেরে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন।
পি কে হালদার যত ঘেরে বিনিয়োগ করেছিলেন, তার সব কটির সন্ধান এখনো পায়নি ইডি। সব সম্পত্তির হিসাব পেতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
ইডি জানায়, ২০১৯ সালের আগেই পি কে হালদার তার কয়েকজন সহযোগীকে ভারতে নিয়ে আসেন। তাদের কেউ কেউ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশে জমিজমা কেনা এবং ঘেরে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। তাদের প্রধান সুকুমার মৃধা। তিনি একদিকে আইনি পরামর্শ দিতে শুরু করেন, অন্যদিকে জমি–বাড়ির দালালি ও মাছের ঘেরের ব্যবসায় নামেন।
সুকুমার মৃধা উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় ব্যবসায়ী, জমির দালাল ও মাছ ব্যবসায়ীদের একটি বড় নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তদন্তকারীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয় যে সুকুমার মৃধা নিজেই এই নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, নাকি অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে পি কে হালদারই তাঁকে দিয়ে এই নেটওয়ার্ক তৈরি করিয়ে ছিলেন। যাতে পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে মাছের ঘের ও আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন।
ইডি জানায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পি কে হালদার ও সুকুমার মৃধা পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ মোটামুটি স্পষ্ট। এর কারণ রাজনৈতিক যোগাযোগ ছাড়া এত কম সময়ে এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা সম্ভব নয়। কাদের সঙ্গে কেমন যোগাযোগ তাঁদের ছিল, সেটা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশে আগেই গ্রেপ্তার হওয়া সুকুমার মৃধার কাছ থেকে কী কী তথ্য পাওয়া গেছে, তা জানতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
ইডি কর্মকর্তারা জানান, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের পাশাপাশি দুবাইয়ে অবস্থানরত সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন পি কে হালদার। তৃতীয় একটি দেশের সিম কার্ড ব্যবহার করে সেখানে যোগাযোগ রাখা থেকে অর্থ পাচার সবই করছিলেন তিনি।
ইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, পি কে হালদারের আত্মসাৎ করা অর্থের একটা বড় অংশ এখনো দুবাইয়ে রয়েছে। হুন্ডির নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দুবাই ও পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই অর্থ পাঠানো হয়েছে।
ইডি জানিয়েছে, পি কে হালদারের কাছে বাংলাদেশ, ভারতের পাসপোর্টের পাশাপাশি গ্রেনাডার পাসপোর্টও পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ইন্টারপোল প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে রেড কর্নার নোটিস (আরসিএন) জারি করেছে।’
পি কে হালদারকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের ইঙ্গিত দিয়ে ইডি কর্মকর্তারা দা টেলিগ্রাফকে জানান, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পি কে হালদারকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ইডির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা হালদারকে রবিবার আদালতে তুলব। শেষ পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হবে।
ভারতীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, পি কে হালদারকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের পেছনে দুটি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বাংলাদেশের আর্থিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধ, অন্যটি তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পি কে হালদার ও তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, পি কে হালদারের হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তাঁর মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। তবে এসব হিসাবে এখন জমা আছে ১০ কোটি টাকার কম। অন্যদিকে পি কে হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বের করে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব টাকা দিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কেনা হয়। তবে ঋণ নেওয়া পুরো টাকার হদিস মেলেনি। নিয়ন্ত্রণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদে বসেছেন পি কে হালদারের একসময়ের সহকর্মী ও আত্মীয়রা। আর মালিকানা পরিবর্তনে সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুদক জানায়, পি কে হালদারের দখল করা চারটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও রিলায়েন্স লিজিং (বর্তমান নাম আভিভা ফাইন্যান্স) থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে।
দুদক পি কে হালদারের প্রায় এক হাজার কোটি টাকার মূল্যের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করেছে। এ ছাড়া তাঁর ও তাঁর অর্থ কেলেঙ্কারির সহযোগীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৪টি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় পি কে হালদারসহ আসামি ৮০ জন। এর মধ্যে গ্রেপ্তার ১২ জন বর্তমানে জেলে।
এ পর্যন্ত আলোচিত পি কে হালদারের ৮৩ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩৩ জনের সম্পদের হিসাব বিবরণী চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। পি কে হালদারের ৬৪ সহযোগীর বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।