পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে দালাল ধরে বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে গত বছর সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন পলি বেগম (৪৫)। তবে সেখানে যাওয়ার পরই পলি বেগমের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতনে পলি বেগম গুরুতর আহত হয়েছেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি এখন সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের আইসিউতে কাতরাচ্ছেন।
পলির বাড়ি গাজীপুরে। তাঁর বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বাটাজোর গ্রামে। পলির ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ১১ মে ঢাকার জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সেলে লিখিত অভিযোগ করেছেন পলির স্বামীর আসির উদ্দিন।
আবেদনে আসির উদ্দিন বলেছেন, তাঁর স্ত্রী পলি গত বছরের ১৯ অক্টোবর মেসার্স জেনিয়া ওভারসিজের (আরএল-১২২০) মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর থেকে তাঁর স্ত্রীকে অত্যাচার, মারধর, নির্যাতন করা হচ্ছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তাঁর স্ত্রীকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ বিষয়টি তিনি এজেন্সিকে জানালেও সেখান থেকে কোনো সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেন।
আসির উদ্দিন বলেন, পলিকে ১৬ মে সৌদি আরবের রিয়াদের অ্যাটলাস জেনারেল হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি করা হয়। এই খবর পরিবার জানত না। ওই হাসপাতালে রিংকু শেখ নামে ভারতের কলকাতার এক নাগরিক কাজ করেন। রিংকু শেখের সহায়তায় পলি ইমোতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় পলি দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আকুতি জানান।
আসির উদ্দিন বলেন, ‘পলির অবস্থা ভালো মনে হয়নি। সে সৌদি আরবের যেখানে কাজ করত, ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী ও তাঁর মেয়ে তিন দিন আগে প্রচণ্ড মারধর করেন। পরে অবস্থা মৃতপ্রায় দেখে ওই বাড়ির লোকজনই পলিকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।’
রিংকু শেখের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। রিংকু শেখ বলেন, তিনি আইসিউতে খাবার দিতে গেলে পলি বেগম তাঁকে ইশারায় ডাকেন। পরে কোনো রকমে পলি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি পলিকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইমোতে কথা বলিয়ে দেন।
পরে রিংকু শেখের মাধ্যমে পলির সঙ্গেও এই প্রতিবেদকের কথা হয়। হাসপাতালের শয্যা থেকে পলি বলেন, তিন দিন আগে তাঁকে কয়েক দফা মারধর করা হয়। পরে তিনি টয়লেটে যান। সেখানে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। পরে আর তাঁর কিছুই মনে নেই। তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে বাঁচান, আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেন।’
গত বছরের ১৯ অক্টোবর মেসার্স জেনিয়া ওভারসিজের (আরএল-১২২০) মাধ্যমে সৌদি আরব যান পলি বেগম। গাজীপুরের স্থানীয় মুকুল নামে এক ব্যক্তি পলিকে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। আসির উদ্দিনের কাছ থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে ও মুকুলের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
আসির উদ্দিন বলেন, তাঁর স্ত্রীকে দেড় হাজার রিয়াল বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরব গিয়ে পলি বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। কয়েক মাস ধরে তাঁরা পলিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন। এদিকে সুযোগ পেলেই পলি পরিবারের কাছে ভিডিও পাঠান। সব কটি ভিডিওতে পলির দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন।
পলির কয়েকটি ভিডিও তিনি কয়েক মাস আগে স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন। ভিডিওতে পলি বলেন, ‘এখানে আসার পর ১৫ দিন ভালো ব্যবহার করছে। তারপর আর কাপড়চোপড় দেয় না, খাওনদাওন দেয় না। খাবার খুব সমস্যা। খাবার চাইলেই মারে। বেতন চাইলে মারে।’
আরেকটি ভিডিও বার্তায় পলি জানিয়েছেন, স্বামীর সঙ্গে কথা বলার কারণে বাড়ির মালিক তাঁর মোবাইল কেড়ে নিয়েছে। পলি বলেন, ‘এখানে খাওন দেয় না। রুমে তালা দিয়ে রাখে। আপনারা আমারে বাঁচান দয়া করে। আপনারা আমাকে বাংলাদেশে নেন দয়া করে। নয় তো আমার বাসাটা পরিবর্তন করে দেন। এমন বাসা দেন, যারা চারটা ভাত ফেলে দেয়, আমি সেই ভাত খেয়েও যেন বাঁচতে পারি।’
পলি ও তাঁর স্বামী স্থানীয় দালালকে কয়েকবার ফোন দিলেও দালাল নানা টালবাহানা করেছেন। অনেক সময় কল ধরে দালাল তাঁদের গালিগালাজও করেছেন বলে আসির উদ্দিন দাবি করেন।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (প্রশাসন) উপপরিচালক জোহরা মনসুর কে বলেন, তাঁদের কাছে অভিযোগ আসলে তাঁরা সাধারণত এজেন্সিকে এ ব্যাপারে চিঠি দেন। আর যেহেতু ওই নারী এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন, এটা গুরুতর। এ কারণে তাঁরা দ্রুত দূতাবাস ও এজেন্সিকে এ ব্যাপারে চিঠি দেবেন। প্রয়োজনে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাবেন।