সরকারের দিক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার মূল দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এ জন্য প্রায় আট বছর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি সেল গঠন করে। এর নাম ‘দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল।’ দেশে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর গঠিত সেলটি আছে শুধু নামেই। এটি দ্রব্যমূল্য নিয়ে পর্যালোচনাও করছে না, কোনো পূর্বাভাসও দিচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য তাদের ওয়েবসাইটে ঘোষণা দিয়ে বলেছে, দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল নিত্যপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা, আমদানির পরিমাণ, মজুত ও সংগ্রহ পরিস্থিতি, বিতরণব্যবস্থাসহ বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে থাকে। সেলটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারদরের তুলনামূলক বিশ্লেষণও করে।
বোঝাই যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সেলের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। উপসচিব থেকে বাণিজ্যসচিব পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এ কাজ কোনো গবেষণা সংস্থাকে দিয়েই করানো উচিত।
এ কাজের অংশ হিসেবে সেলটির বিভিন্ন সংস্থা থেকে নিত্যপণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারদর, বন্দরে পণ্য খালাসের পরিমাণ, আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্য নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করা এবং এরপর বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের করণীয় নির্ধারণেও সহায়ক হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু ২০২০ সালের ২২ জুন থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সেলটির কাজ সম্পর্কে মাত্র সাড়ে পাঁচ লাইনের কিছু কথা রয়েছে। অর্থাৎ পৌনে দুই বছর ধরে সেলটির কার্যকলাপের কোনো হালনাগাদ তথ্যের উল্লেখ নেই মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে।
বাণিজ্যসচিবসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিসিএস ক্যাডারের ৭৫ জন কর্মচারী কাজ করছেন। ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও (পিও) রয়েছেন। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রশাসন, রপ্তানি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) নামে চারটি অনুবিভাগ রয়েছে। সেল রয়েছে তিনটি। এগুলো হচ্ছে ডব্লিউটিও, পরিকল্পনা এবং দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল। আর শাখা রয়েছে একটি। এর নাম পরিচালক, বাণিজ্য সংগঠন (ডিটিও)।
দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলটি আইআইটি অনুবিভাগের আওতাধীন। এ সেলে কাজ করেন মাত্র দুজন। তাঁরা হলেন বাণিজ্য পরামর্শক জিয়াউর রহমান ও সহকারী বাণিজ্য পরামর্শক শ্যামা পদ বিশ্বাস। জিয়াউর রহমান অফিশিয়াল কাজে বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় রয়েছেন।দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস দেওয়ার কাজের তাহলে কতটুকু কী করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দুই কর্মচারী? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া সম্ভব হয়নি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বিদেশে থাকার কারণে।
আইআইটি অনুবিভাগের প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল কী পর্যালোচনা করছে এবং পূর্বাভাস কী দিচ্ছে, তা জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘আমরা বৈঠক করি এবং প্রতিবেদন তৈরি করি।’জনগণ কোনো পূর্বাভাস পাচ্ছে কি, এমন প্রশ্নের জবাবে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের আরেক দপ্তর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের ওঠানামার তথ্য জানাচ্ছে। সবাই তা দেখতে পাচ্ছেন। সবকিছু তো জনগণকে জানানো সহজ কাজ নয়।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে একটা বৈঠক করা হয়, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি এবং বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত থাকেন।এ ধরনের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি, বিটিটিসি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারের তুলনামূলক পার্থক্য এবং এনবিআর কর–সংবলিত তথ্য উপস্থাপন করে। ব্যবসায়ীরাযে যাঁর অবস্থান থেকে তাঁদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এরপর চা-নাশতা খেয়ে সবাই বিদায় নেন। খুচরা ব্যবসায়ী বা ভোক্তাদের কোনো প্রতিনিধিকে বৈঠকে ডাকা হয় না। ফলে বৈঠক থেকে ভোক্তাস্বার্থ–সম্পর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত আসে না।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সেলের পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। উপসচিব থেকে বাণিজ্যসচিব পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এ কাজ কোনো গবেষণা সংস্থাকে দিয়েই করানো উচিত।’
বিটিটিসি চেয়ারম্যান মো. আফজাল হোসেন গতকাল বুধবার মুঠোফোনে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখন যে পণ্যের দাম পর্যালোচনা করতে বলে, আমরা তা করে দিই। বিশেষ করে আমদানি করা পণ্যের ব্যাপারে। মূল্য, পরিবহন খরচ, কর, লাভ ধরে আমরা বিশ্লেষণ করি। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে যদি বলি, আমরা বলেছিলাম প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা হতে পারে। তবে নানা অজুহাতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেউ কেউ বেশি দাম নিচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ জন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’