নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু ছাড়াও পথচারী-নারীসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৬ জন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন পুলিশসহ অর্ধশতাধিক মানুষ।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় দেড় ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে চারটি মোটরসাইকেলে আগুনসহ সাত থেকে আটটি যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী শাওন প্রধান (২০) ফতুল্লার এনায়েতনগর এলাকায় একটি কারখানায় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বাড়ি পার্শ্ববর্তী বক্তাবলী ইউনিয়নের পূর্ব গোপালনগর এলাকায়।
সংঘর্ষে যে ২৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সবাইকে ঢাকায় পাঠানো হয়। হাসপাতালের রেজিস্টারের তথ্য অনুযায়ী, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিরা হলেন শাহীন (৪০), জাহাঙ্গীর (৩০), রাজ (২৬), শরীফ (২৫), ইউনুস (৪৩), সাগর (২২), আবদুস সালাম (৬০), মো. আক্তার (৫২), মুন্না (১৮), কাদির (২৭), শরিফুল ইসলাম (১৯), শাহনাজ (৫০), সবুজ (৩৪), মোমেন (৫৫), শিহাব (২৫), শামসুল হক (৫০), শিল্পী (৪০), ইব্রাহিম (২৫), তাজুল ইসলাম (৩০), আশরাফুল (৩২), সোয়াদ হোসেন (৩০), উজ্জ্বল ভৌমিক (২৮), মিন্টু (২৮), সজিব (১৮), মো. নাছির (৪০), গৌতম সাহা (৩৩)। এ ছাড়া পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত হন আয়েশা সুলতান (১৮), লামিয়া (১৫) ও উম্মে হানি (১৪)।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সকাল ১০টার দিকে বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে শোভাযাত্রা করতে নগরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকার আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগারের সামনে নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির কয়েক শ নেতা-কর্মী শোভাযাত্রা বের করতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ লাঠিপেটা করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। এ সময় শহরের ২ নম্বর রেলগেট ও আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল আজ দুপুরে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা অনুমতি না নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। জানমালের ক্ষতি এড়াতে কাঁদানে গ্যাস ও শটগানের গুলি ছোড়ে পুলিশ। তবে গুলিতে কেউ মারা গেছেন কি না, তা তিনি জানেন না। সংঘর্ষে পুলিশের ১৫ সদস্য আহত হন বলে তিনি দাবি করেন।
সংঘর্ষের জন্য পুলিশকে দায়ী করে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর শত শত রাউন্ড শটগানের গুলি করেছে। এটা খুবই লজ্জাজনক। একটি স্বাধীন দেশে পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।
যুবদলের কর্মী শাওন প্রধানের মৃত্যুর পর আজ দুপুর থেকে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, ডোরাকাটা সাদা রঙের টি-শার্ট ও কালো জিনস পরা শাওন মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন।
বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রায় অংশ নিতে ডিআইটি এলাকায় আসেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের দলের সামনে শাওনসহ চার-পাঁচজন ছিলেন। পুলিশ যখন গুলি ছোড়ে, তখনো শাওন সামনে ছিলেন। এরপর গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লে তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁরা।
শাওনের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তাঁর বড় ভাই ফরহাদ প্রধানসহ স্বজনেরা। লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। ফরহাদ বলেন, তাঁর ভাই একটি কারখানায় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন শাওন। এরপর তিনি খবর পান তাঁর ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নগরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকা থেকে কয়েক শ নেতা-কর্মী শোভাযাত্রা বের করতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে
জেলা সিভিল সার্জন মশিউর রহমান বলেন, সংঘর্ষে শাওন নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। বুকের মাঝ বরাবর ছোট গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি বলেন, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ২৬ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত ৪ জন এবং ইটপাটকেলে আহত ১০ পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক আজ সন্ধ্যায় বলেন, গুলিবিদ্ধ আটজন হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন।
এর আগে গতকাল বুধবার বিকেলে ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ মারমুখী হয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করে। পুলিশের লাঠিপেটায় সেদিন আহত হন বিএনপির ১৫ নেতা-কর্মী।