বাজারে চাহিদা আছে, মানের দিক থেকেও গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে। তবু দিন দিন মিল্ক ভিটার দুধ সংগ্রহ কমছে। সমানতালে কমছে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা। ২২টি পণ্য উৎপাদনের কথা বললেও পাস্তুরিত দুধ ছাড়া তাদের বাকি পণ্যগুলো সব জায়গায় পাওয়া যায় না। আবার সব খুচরা দোকানে মিল্ক ভিটার পাস্তুরিত দুধও পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে দোকানিরা বলেছেন অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কমিশন কম পাওয়ার কথা।দুগ্ধ খাতে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড বা মিল্ক ভিটার প্রতিযোগীদের মধ্যে আড়ং ডেইরি, প্রাণ ডেইরি, আকিজ ডেইরি, রংপুর ডেইরি, আফতাব ডেইরি উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি রাজধানীর কয়েকটি সুপারশপ ঘুরে দেখা যায়, মিল্ক ভিটার পাস্তুরিত দুধ কম-বেশি পাওয়া গেলেও তাদের বাকি সব পণ্য থাকে না। তবে অন্য বড় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব পণ্যই থাকে।
মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ জানায়, বাজারে যত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি হয়, তার ৬০ শতাংশই তারা সরবরাহ করে। তাদের সচল কারখানা আছে ৫৪টি। দিনে দেড় থেকে দুই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকে। মিল্ক ভিটায় পাস্তুরিত দুধ, টোনড মিল্ক, ফ্লেভারড মিল্ক, লাবাং, মাঠা, ক্রিম, বাটার, ঘি, ননিযুক্ত গুঁড়া দুধ, ননিবিহীন গুঁড়া দুধ, চকলেট (ক্যান্ডি), আইসক্রিম, চকবার, ললিস, রসমালাই, মিষ্টি দই, টক দই, রসগোল্লা, কাঁচা সন্দেশ, প্যারা সন্দেশ, চিজ ও কেক উৎপন্ন হয়।এসব পণ্যের মধ্যে পাস্তুরিত দুধের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকার দোকানি মো. কামাল বলেন, মিল্ক ভিটার দুধের চাহিদা আছে। কোনো দিন না রাখলে ক্রেতারা এসে খুঁজে যান। কিন্তু কমিশন কম পাওয়া যায় বলে তিনি এই দুধ রাখার জন্য ততটা আগ্রহ পান না।
যেভাবে কমছে দুধ সংগ্রহ ও মুনাফা
পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মিল্ক ভিটার মুনাফা কমেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক মুনাফা ছিল ১৩ কোটি টাকার বেশি। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ১ কোটি ১১ লাখ টাকায় নেমে আসে। আর করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে মুনাফা হয়েছে মাত্র ১৩ লাখ টাকা।শুধু আয়ই নয়, দুধ সংগ্রহও কমেছে মিল্ক ভিটার। তারা সারা বছরই খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মিল্ক ভিটা সংগ্রহ করে ৬ কোটি ২৭ লাখ লিটার দুধ। সেখানে ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে গত অর্থবছরে তাদের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১০ লাখ লিটার। ২০১৫ সালের পরের চার বছর মিল্ক ভিটার দুধ সংগ্রহে দামও কিছুটা কমেছে। তবে গত অর্থবছরে দাম কিছুটা বেড়েছে। এ সময় প্রতি লিটার দুধ সংগ্রহের জন্য তাদের দিতে হয় ৪০ টাকা ৫৩ পয়সা।
বর্তমানে বাজারে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মিল্ক ভিটার পাস্তুরিত দুধের দাম বেশি। তাদের এক লিটার দুধের দাম ৭৫ টাকা। সেখানে আড়ং, প্রাণের দুধ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদের চেয়ে দাম বেশি হওয়ার পরও দাম আরও বাড়াতে চায় মিল্ক ভিটা। গত ১৩ মার্চ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে। কারণ হিসেবে করোনার সময়ে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করতে না পারার কথা বলা হয়েছে।
যেসব কারণে পিছিয়ে পড়ছে
মিল্ক ভিটার একটি সূত্র বলেছে, বাজারজাত নীতিতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। অন্যরা দোকানিদের যে পরিমাণ কমিশন দেয়, তা মিল্ক ভিটা দিতে পারে না। কোনো প্যাকেট যদি নষ্ট হয়, তখন মিল্ক ভিটা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বদলি হিসেবে পণ্য দেয়। এতে দোকানিরা আগ্রহী হন না। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের সুবিধাও দিয়ে থাকে। তাই দোকানিরা অন্য কোম্পানিতে আগ্রহ বেশি দেখান।নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিল্ক ভিটার একটি সূত্র বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী বা মিল্ক ভিটার সমিতির কিছু অসাধু ব্যক্তি বড় কোনো ক্রেতা বা বিশেষ কোনো শ্রেণির কাছে দুধ বিক্রি করে দেন।
প্রচারণায় পিছিয়ে রয়েছে মিল্ক ভিটা। তাদের ফেসবুক পেজে সর্বশেষ পোস্ট দেওয়া হয়েছে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। বাজারে অন্যরা যেভাবে অনলাইনে মার্কেটিং করে, মিল্ক ভিটা তা করে না।
মুনাফা ও দুধ সংগ্রহ কমার বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এটা হতে পারে। তা ছাড়া যোগাযোগ পরিস্থিতি ভালো হওয়ায় অনেক খামারি সরাসরি দুধ ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাঁরা তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে তাঁদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে।রফিকুল ইসলাম বলেন, মান ধরে রাখতে সামনে দাম আরও বাড়ানো লাগতে পারে। মিল্ক ভিটা নিম্নমানের দুধ কম টাকায় দিতে চায় না। দোকানিদের কমিশন নিয়ে তিনি বলেন, মিল্ক ভিটা সামর্থ্য অনুযায়ী কমিশন দিয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার বাজারে অন্যরা বেশিও দিতে পারে। তবে তাঁরা চেষ্টা করছেন মান ধরে রেখে এগিয়ে যেতে।