মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারোয়ার আলী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আমরা লজ্জা পাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এতে সরকার লজ্জিত হয় না, প্রশাসন লজ্জিত হয় না। এ বাস্তবতায় সারা দেশের মানুষ লজ্জিত।’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ত্বকীর ঘাতকদের প্রশ্রয় দিয়েন না। এ জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিলে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। এদের প্রশ্রয় দিলে সমাজে বার্তা পৌঁছায় যে একজন নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করলে আমার কিছু হয় না। তাহলে কেন এই দায় নেবে সরকার, কেন দায় নেবে প্রশাসন? আমরা অবিলম্বে ত্বকী হত্যার বিচার চাই। র্যাব যে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, ওই অভিযোগপত্রের আলোকে বিচার চাই।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে (যেখানে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয়) নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ৯ বছর উপলক্ষে ‘আলোর ভাসান’ অনুষ্ঠানে বক্তব্যের সময় তিনি এসব কথা বলেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায়ের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন লেখক ও গবেষক মফিদুল হক, নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি প্রমুখ।
সারোয়ার আলী বলেন, ‘৯ বছর আগে একজন নিষ্পাপ মেধাবী কিশোরকে কোনো অপরাধ ছাড়াই নিষ্ঠুরভাবে এ শহরে খুন করা হয়েছে। সেটির বিচার এ দেশের মানুষ পায়নি যখন ভাবি, তখন প্রশ্ন ওঠে আমরা কোন দেশ স্বাধীন করলাম? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত দেশটিতে আর কিছু না হোক, অত্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু আইনের শাসন যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এটি ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়ার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। ত্বকী হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত, শুধু নারায়ণগঞ্জের মানুষ নয়, সারা দেশের মানুষ জানে। গণভবনের মানুষ জানে না, এটি বিশ্বাস করতে হবে?’
অনুষ্ঠানে মফিদুল হক বলেন, ‘ত্বকীকে যারা হত্যা করেছে, তারা একটি সুস্পষ্ট বার্তা পেয়ে গেছে। আজ হোক, কাল হোক, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবেই। সমাজে যদি সুস্থতা প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে এ হত্যার বিচার করতেই হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের নামে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির নামে যত রকমের অপকর্ম করে, তাদের আমরা ঘৃণিত শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করি। সেই ঘৃণা যেন নিরন্তর তাদের বিদ্ধ করে।’
মফিদুল হক আরও বলেন, ‘আমরা আইনের শাসন চাই, যে শাসন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করবে। আর আইনের যারা অপব্যবহার করে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে যারা পদদলিত করে, তাদের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীর জাগরণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তির জাগরণ। এ জাগরণে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি করছেন, তাঁদের এ দাবি পূরণ করতে হবে। যারা রাজনীতির লেবাসে রক্তপাত করছে, তাদের অবশ্যই পরাজিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে উপলব্ধি করতে হবে, তাঁর ছায়াতলে যারা আছে, সেই ঘৃণিত অপশক্তিকে অবশ্যই তাঁকে দমন করতে হবে। এখানে দমনেরও প্রশ্ন নয়, আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়ার প্রশ্ন। সেখানে কেউ যাতে প্রভাব বিস্তার বা বাধা তৈরি করতে না পারে, সেটা সরকার, প্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘৯ বছর ধরে আমরা ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আসছি। আমাদের নারায়ণগঞ্জের মানুষ, দেশ ও দেশের বাইরের মানুষও বিচার চেয়ে আসছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিচার এখনো হয়নি। র্যাব ঘাতক কারা, সেটি প্রকাশ করার কারণেই ত্বকী হত্যার বিচার বন্ধ হয়ে আছে, আমরা সেটি বুঝতে পারছি।’
তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যার ১০ বছর হলেও বিচার হচ্ছে না। তদন্তকারী সংস্থা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি বলে ৮৪ বার সময় নিয়েছে। কিন্তু ত্বকীর ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো, ত্বকী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের কারণে বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ত্বকী হত্যার পর দেশে সাত খুনসহ চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যার বিচার হয়েছে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে সরকার যেসব হত্যার বিচার করা প্রয়োজন মনে করে, সেগুলোর বিচার হয়। যেগুলো বন্ধ রাখার প্রয়োজন, সেগুলো বিচার করে না। ত্বকীর ঘাতক আজমেরী ওসমান দলবল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে ঘুরে বেড়ালেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
রফিউর রাব্বি আরও বলেন, ‘ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি করে। তারা কখনোই সুস্থ ধারার রাজনীতি করেনি। নারায়ণগঞ্জে লাশের রাজনীতি ওসমান পরিবার শুরু করেছে। তারা বহু লাশ এই শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলেছে। বহু লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। চিহ্নিত হত্যাকারী ঘাতক, যারা লাশের রাজনীতি করে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা করে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তারা লাশ ফেলে মানুষকে ভয় দেখাতে চায়। আমরা চাই, এ সরকারের আমলে ত্বকী হত্যার বিচার করা হোক। মন্ত্রী-এমপিরা গডফাদারদের রক্ষা করতে পারবেন না। অবশ্যই আমরা বিচার আদায় করে ছাড়ব।’
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে খেলাঘর আসরের জেলা সভাপতি রথীন চক্রবর্তী, ন্যাপের জেলা কমিটির সম্পাদক আওলাদ হোসেন, বাসদের জেলা সমন্বয়ক নিখিল দাস, সিপিবির জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জেলা সভাপতি লক্ষ্মী চক্রবর্তী, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।