পুতিন যেমন জ্বালানিকে ব্যবহার করে বহির্বিশ্বে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ খাটায়, তেমন জ্বালানি সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনেও সে রাশিয়ার রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগায়। বিশ্বের তেল ও গ্যাসের মজুদে রাশিয়ার আধিপত্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সে কাজ করছে।
কেবল ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করেই সে ক্ষান্ত নয়; পুতিন রাশিয়াকে এশিয়ার মূল জ্বালানি সরবরাহকারী করার চেষ্টা করছে। ভারত, চীন ও জাপানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের দিকে তার মূল মনোযোগ। পুতিন একটি নতুন পশ্চিম সাইবেরিয়ান তেল পাইপলাইনের জন্য বড় চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন যা চীনকে ৪০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের গ্যাস সরবরাহ করবে এবং এ চুক্তি চীনকে রাশিয়ার গ্যাসের প্রাথমিক গ্রাহক করে তুলবে। এভাবে রাশিয়ার বিস্তৃতি ক্রমাগত বাড়বে; এশিয়ার ক্রমবর্ধমান এবং প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলির সাথে তার জ্বালানি-ভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
বৈশ্বিকভাবে আরেকটি গুরত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ ইরান। ইরানের সাথে রাশিয়ার রাজনৈতিক জোট একটি “রাশিয়া-ইরান জ্বালানি অক্ষ”-তে পরিণত হয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহে মস্কো বেশ সুবিধা পাচ্ছে। ইরানের সাথে আমেরিকার পারমাণবিক চুক্তি এবং তেহরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রাশিয়া ও ইরানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জ্বালানিশক্তির খাতে সহযোগিতা শুরুর পথ পরিষ্কার করেছে। দুটি দেশই গ্যাস ও তেল বিনিময় চুক্তি করেছে। এ ছাড়া পাইপলাইন ও এলএনজি সরবরাহের চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছে। এ ছাড়া, ওপেকের নেতৃত্বদানকারী দেশ এবং রাশিয়ার চেয়ে অধিক তেল রপ্তানিকারক একমাত্র দেশ সৌদি আরবকে রাশিয়া ও ইরান টারগেট করেছে। রাশিয়ার সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দ্বারা সমর্থিত ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের পুতিনকেন্ত্রিক জোট সৌদিকে ঘেরাও করেছে।
কেন মিত্র বাশার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে রাশিয়া সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে এ বিষয়টি নিয়ে যারা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন তারা নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন, ইউক্রেন সংকট থেকে মনোযোগ সরানো অথবা ন্যাটোকে দুর্বল করে দেয়া। তবে অনেকের চোখই যে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে তা হলঃ সিরিয়ায় পুতিনের হস্তক্ষেপ তাকে তার একটি বৃহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নের সহযোগিতা করবে। আর তা হচ্ছে, বৈশ্বিক তেল সরবরাহকারী হওয়ার দৌড়ে প্রথম হওয়া। সে কীভাবে এটা অর্জন করবে? সৌদিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য তার নতুন জোটকে ব্যবহার করবে। সৌদি সস্তায় তেল বিশ্ববাজারে ছেড়ে তেলের দাম অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। যা রাশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুতিন এ অবস্থাটা বদলাতে চায়। সে রাশিয়ার গ্যাসের ক্ষেত্রে যা করেছিল তেলের ক্ষেত্রেও তা-ই করতে চায়। পুরো ইউরোপীয় বাজার যেন রাশিয়ার তেলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। কিন্তু এটি করতে গেলে সৌদিকে তার রাজত্বের আসন থেকে সরাতে হবে। ইরান, সিরিয়া ও ইরাকের সাথে জোটবদ্ধ হলে পুতিন হয়তো এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
কিছু বিশ্লেষণমতে, এ উদ্দেশ্যগুলো থেকে বোঝা যায় পুতিনের সিরিয়ায় লক্ষ্যটি কি। সেখানে সে ইতিমধ্যেই রাশিয়ার স্পেশাল ফোর্সকে নামিয়েছে, এবং খুব সম্ভবত দেড় লক্ষ রাশিয়ান পদাতিক সৈন্য সেখানে পাঠাবে। পুতিন স্পষ্টতই সেখানে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়লেও অন্তত ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাশিয়ার আক্রমণ ছিল বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাওয়া সিরিয়ার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। আইসিসের রাশিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমানে বোমা হামলা ও নভেম্বর ২০১৫ সালে পরিচালিত প্যারিস হত্যাকাণ্ডের কারণে সে মানুষকে বুঝিয়েছিল যে সে আসলেই এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তে চায়। কিন্তু দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায় যে পুতিনের লক্ষ্য আগের মতোই ছিল: বিদ্রোহীদের দমন করা, আসাদকে বাঁচানো ও সিরিয়ার এই স্বৈরাচারকে আইসিসের বিকল্প হিসেবে আনা। সে তার এসব লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যা ২০১৬ সালের মার্চে তার রাশিয়ান সৈন্য ফিরিয়ে আনার ঘোষণা থেকে বোঝা যায়। তেলের সরবরাহ ও মূল্যের ব্যাপারে সৌদিকে চাপে রাখতে পুতিন তার মিত্রদের ব্যবহার করবে।
সময়ই বলে দেবে পুতিন কতদূর যেতে পারবে। রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোট যুদ্ধের দিকেও ধাবিত হতে পারে। যেহেতু সৌদি তাদের বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে চায়। এ ছাড়া তাদেরকে নিজেদের তেলক্ষেত্রগুলোর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। এ তেলকূপগুলো ইয়েমেনিভিত্তিক হুথি বিদ্রোহীদের হুমকির সম্মুখীন। এ হুথিদের প্রশিক্ষণ দেয়া ও অর্থ সরবরাহ করে ইরান।
এবং পুতিন সৌদিদের জন্য বিকল্প অপশন তৈরীতে কাজ করছে। তবে এটি হবে সহযোগিতামূলক, যেখানে উভয়ই তেলের দাম বৃদ্ধিতে একসাথে কাজ করবে। তবে এ লক্ষ্য সৌদি ও রাশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ইরানও একই কামনা করে। এ জন্য পুতিন তেল চুক্তিতে নিয়ে আলাপের উদ্দেশে প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স সালমানের সাথে সাক্ষাৎ করে। পুতিন স্বীকার করেছেন যে রাশিয়া ও সৌদি আরব এখনও সম্মতিতে আসতে পারে। Institutional Strategist-এর সম্পাদক ল্যারি জেদোলাহ বলেছেন,
দেখার বিষয় হচ্ছে এই চুক্তিটি যেখানে ইরান হুথিদের সহায়তা দেয়া বন্ধ করবে। বিনিমতে, সৌদি দৈনিক ১০.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন বন্ধ করবে এবং উৎপাদন কমাবে। রাশিয়া এই চুক্তির পেছনে দালালি করে কারণ তারা সৌদির তেল উৎপাদন নীতি থেকে সরে আসার দ্বারা নাটকীয়ভাবে লাভবান হতে পারবে। এতে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যারা উভয়ে দৈনিক ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। তারা পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তেলের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে।
জেদোলাহর দৃষ্টিভঙ্গিতে, সৌদি যদি নিশ্চিত হতে পারে যে তাদের তেলকূপগুলি হুমকি থেকে মুক্ত, তবে তারা এত তেল উত্তোলন কমিয়ে দেবে। এতে তাদের উৎপাদন কমে যাবে এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়বে। লাভবান হবে মস্কো, রিয়াদ ও তেহরান।
পুতিনের জ্বালানি নিয়ে স্বপ্ন কেবল কৌশলগত নানা বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয়। সে নতুন নতুন জ্বালানির সুযোগ খোঁজে। রাশিয়ার আর্কটিকে জ্বালানিসম্পদ সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা দেখলেই বিষয়টি বোঝা যায়। পুতিন সেখানে সুপরিকল্পিতভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। আর্কটিকের ৪,৬৩,০০০ বর্গমাইলের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে অনাবিষ্কৃত বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস রিজার্ভের এক চতুর্থাংশ থাকতে পারে। রাশিয়া তার আর্কটিক দাবি বহাল রাখতে সেখানে সামরিক বাহিনী নিযুক্ত করেছে। ছয় হাজার সৈন্যের পাশাপাশি পারমাণবিক আইসব্রেকারসহ ৪০টি আইসব্রেকারের বহর সেখানে আছে। এর বিপরীতে আমেরিকার মাত্র দুটি আইসব্রেকার। রাশিয়ার আগ্রাসননীতির কারণে “অনুসন্ধান অধিকার” ও শতাব্দী পুরোনো সীমান্ত চুক্তি নিয়ে নরওয়ের সাথে তাদের সংঘাত বেঁধেছে। ইতিমধ্যেই এটি বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। পুতিন আর্কটিকের দাবি যত বাড়াবে এ সংঘাত তত তীব্র হবে।
আর্টটিকসহ অন্যান্য জায়গায় রাশিয়া চিন্তাচেতনা ও কৌশলগত দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল গ্যারি রগহেড লিখেছেন,
ওয়াশিংটন আর্কটিকের তেল অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং এজেন্সির অভিজ্ঞতাকে প্রদর্শন করতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি সতর্ক করেছেন যে আমেরিকার এ “নির্লিপ্ততার শীঘ্রই সমাপ্তি হওয়া উচিত।” তিনি ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কাউন্সিলের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের দিকে ইঙ্গিত করেন যেখানে এসেছে যে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর্কটিকে জ্বালানির অনুসন্ধান না বাড়ায়, তবে তাকে “আমদানি করা তেলের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি নিতে হবে এবং আর্কটিকে আমেরিকার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, নেতৃত্ব ও প্রভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷” আমাদের অনুপস্থিতিতে রাশিয়া (চীনকে সাথে নিয়ে) একাই ভোগদখল করবে।
মধ্য এশিয়ায় কাজাখস্তানে উল্লেখযোগ্য তেল ও গ্যাসক্ষেত্র আছে। এ ছাড়া তারা সে অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন উৎপাদনেও শীর্ষে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি রসনেফট কাজাখস্তানকে মস্কোর জ্বালানি কক্ষপথে আটকে ফেলেছে। রাশিয়া-নির্মিত পাইপলাইনগুলি বছরে সাত মিলিয়ন টন কাজাখ তেল চীনে সরবরাহ করে। এ চুক্তির ফলে তিনজনই উপকৃত হয়: চীনারা তেল পায়, কাজাখস্তানের বেইজিং ও মস্কোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং রাশিয়াও মধ্য এশিয়ায় কাজাখস্তানের মতো দেশকে পাশে পায়। এ ছাড়া রাশিয়া-কাজাখস্তান-চীন তেল পাইপলাইন থেকে সরাসরি যে অর্থনৈতিক সুবিধা আসে তা হলো: শত শত বিলিয়ন পেট্রোডলার রাশিয়ায় ঢোকে।