তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন?….. কখনো কখনো এই প্রশ্ন আপনার মনেও উদিত হয় তাই না?
হ্যাঁ আমাদের আজকের কন্টেন্ট এই বিষয়টিকে ঘিরেই।
আসুন, তার আগে জেনে নেই তাকদীর কী?
তাকদীর হল নির্ধারিত ভাগ্য। এ মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে আল্লাহ তার পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব কিছু নির্ধারণ করেছেন – এই বিশ্বাসকে ইসলামে তাকদীর বলা হয়। তাকদির নিয়ে আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? এটা এমন এক দারুণ কনসেপ্ট যা আমাদেরকে আমাদের কাজের গুরত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। যখন আমরা এই ভাবনার গভীরে ডুবে যায়, নিজেদের উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের এক প্রগাঢ় বুঝ আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে।
এটা সত্য যে আমাদের প্রতিটা কাজই যে নির্ধারিত তার স্বীকৃতি তাকদির দিয়েছে। কিন্তু এতে আমাদের কাজ করার গুরত্ব নাকচ হয়ে যায় না। বরং, জীবনে প্রতিটি কাজে যেন আমরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি তার জন্য এটি উৎসাহিত করে। আমাদেরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও চয়েস করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আমাদের কাজগুলো আমাদের দায়িত্বগুলো পূরণ করার, সমাজে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার এবং আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য উৎসাহিত করার একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। এসবের মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাকদিরে তো সব নির্ধারিতই। কিন্তু আমাদের নিজেদের চরিত্রকে গঠন করার ও চারপাশের পৃথিবীকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে আমাদের মাঝে।
তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন?
একজন কৃষকের কথাই ভাবুন। তিনি জানেন বৃষ্টিপাত হলে তার ফসলগুলো পানি পাবে। তিনি কি অলসভাবে বসে থাকবেন যেন প্রকৃতি এসে নিজে তার জমিতে পানির ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়? না! তিনি মাটি প্রস্তুত করেন, বীজ বপন করেন এবং যত্নের সাথে ক্ষেতে চাষাবাদ করেন। তার এই কাজের মধ্যে তাকদিরের পাশাপাশি মানব প্রচেষ্টার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। তিনি জানেন, আবাদে সুফল লাভ করতে হলে তার কাজের কোন বিকল্প নেই।
তেমনি জীবন নামক ভ্রমণতরীতে আমাদেরকেও উদ্দেশ্য ও প্রত্যয় নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
সবই তাকদিরে লেখা থাকার অর্থ সবকিছু সম্পর্কে ইতিমধ্যে পরিকল্পনা করা হয়ে গিয়েছে। তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন? আমাদের প্রচেষ্টা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ, গ্রহণ করা প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিজেদের মূল্য উদ্দেশের সাথে নিজেকে এক লাইনে আনার সুযোগ।
এ ছাড়া, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার দ্বারা আমরা গুরত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করি, প্রজ্ঞা অর্জন করি এবং চরিত্র গঠন করি। আমাদের কাজগুলো নিজেদের বেস্ট ভার্শন বানাতে সহায়তা করে। আমরা আধ্যাত্মিকভাবে, মানবিকভাবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উন্নত হই।
প্রশ্ন হচ্ছে, সবকিছু যদি তাকদিরে লেখাই থাকে তাহলে পরীক্ষার জায়গা কোথায়?
ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিয়তির উপর বিশ্বাস রাখা। আমরা কিভাবে এতে বিশ্বাস স্থাপন করব? নিয়তিতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য চারটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
১. আল্লাহর জ্ঞান অসীম
আল্লাহ সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন সেটা সাধারণ হোক বা নির্দিষ্ট কিছু। বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যৎ কিছুই তার অজানা নয়।
وَ عِنۡدَهٗ مَفَاتِحُ الۡغَیۡبِ لَا یَعۡلَمُهَاۤ اِلَّا هُوَ ؕ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ وَ مَا تَسۡقُطُ مِنۡ وَّرَقَۃٍ اِلَّا یَعۡلَمُهَا وَ لَا حَبَّۃٍ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡاَرۡضِ وَ لَا رَطۡبٍ وَّ لَا یَابِسٍ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۵۹﴾
আর তাঁর কাছে রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, তিনি ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না এবং তিনি অবগত রয়েছেন স্থলে ও সমুদ্রে যা কিছু আছে। আর কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন এবং যমীনের অন্ধকারে কোন দানা পড়ে না, না কোন ভেজা এবং না কোন শুষ্ক কিছু; কিন্তু রয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবে। [সুরা আনআমঃ ৫৯]
সমুদ্ধের অতলে থাকা গহীন অন্ধকারে কোন ক্ষুদ্র গাছের বীজও যদি গজিয়ে উঠে আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত থাকেন। আর এসব ব্যাপার পূর্বে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। যা যা ঘটছে, তা ঘটারই ছিল। তাদের সামনে ও পিছনে কি আছে তা তিনি জানেন।
২. আল্লাহ আমাদের সিদ্ধান্তকেই আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে লিখে দেন
আমরা জানি আল্লাহর কাছে অসীম জ্ঞান রয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিছুই তার অজানা নয়। দৃশ্য এবং অদৃশ্য সকল কিছুর জ্ঞান তিনি রাখেন। তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন? যখন আমরা বলি তার জ্ঞানের বাইরে কিছু নেই তখন এর মধ্যে আমাদের সিদ্ধান্তও পড়ে। আপনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন বা কিছু থেকে বিরত থাকেন তখন ডিসিশন কিন্তু আপনিই নিয়েছেন আর আপনি কি ডিসিশন নেবেন আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। ঠিক সেভাবেই আপনার জীবনকে তিনি সাজিয়ে দেন।
بَلۡ بَدَا لَهُمۡ مَّا کَانُوۡا یُخۡفُوۡنَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ لَوۡ رُدُّوۡا لَعَادُوۡا لِمَا نُهُوۡا عَنۡهُ وَ اِنَّهُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ ﴿۲۸﴾
বরং (আসল ব্যাপার হল) আগে (দুনিয়াতে) তারা (মিথ্যের আবরণে) যা গোপন করে রাখত এখন তা তাদের কাছে প্রকাশ করা হয়েছে আর তাদেরকে (পৃথিবীতে) ফিরিয়ে দেয়া হলে তারা আবার তা-ই করবে যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, নিশ্চয় তারা হল মিথ্যুক। [সুরা আনআমঃ ২৮]
আল্লাহ বলছেন, তাদেরকে যদি পুনরায় দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয় তাহলে তারা আগে যেসব নিষিদ্ধ কাজ করত তাতেই ফিরে যাবে। তাদের সিদ্ধান্ত একই থাকবে, পরিবর্তিত হবে না। আল্লাহ এটা তাদের সৃষ্টির আগেই জানতেন, আর সেভাবেই তাদের তাকদির নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
৩. আল্লাহ আমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন
আপনি যদিও আপনার নিয়তি সম্পর্কে জানেন না কিন্ত আপনাকে তো হেদায়েতের জন্য কুরআন এবং সৃন্নাহ দেয়া হয়েছে যা দিয়ে আপনি ভালো এবং খারাপের পার্থক্য করতে পারবেন। শুধু হেদায়েতই নয, বুদ্ধিশক্তিও দেয়া হয়েছে আপনাকে। তিনি আপনাকে সাবধান করেছেন যে এই দুনিয়া মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের তুলনায় দুনিয়ার কাটানো করেক বছর কিছুই না। তিনি তো সবই দিয়ে দিয়েছেন
আমাদের। একদম পিওর জাস্টিস। সবকিছু সত্যের দিকেই আমাদের ডাকছে, এই ডাক অগ্রাহ্য করে আমরা আখিরাতে আল্লাহকে দোষারোপ করতে পারব না। আপনি খারাপ কাজ করলে সেটার জন্য আপনিই দায়ী।
৪. আমরা নিয়তি বদলাতে পারব না – আমাদের সামনে শুধু বেছে নেয়ার সুযোগ
আমাদের সামনে অনেকগুলো অপশন আর এত এত অপশন থেকে নির্দিষ্ট কোনোটি বেছে নেরার সুযোগ রয়েছে। আপনি প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অসংখ্য অপশন থেকে বেছে নিয়ে।তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন? যদিও পারিপার্শ্বিকের ওপর আপনার প্রভাব অতি নগণ্য। ধরুন আপনি ভাবলেন কালকে আপনি ট্রেনে করে অফিসে যাবেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই যেতে পারবেন কী না তা কি বলার উপায় আছে? ট্রেনের উপর তো আপনার হাত নেই। যদি ট্রেন দেরি করে আসে তাহলে আপনাকে অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে। কালকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে অথবা ট্রেনের ইঞ্জিন হয়ত নষ্ট থাকবে। হয়ত আপনি রাতে অতিরিক্ত ঘুমিয়ে অফিস মিস করে বসবেন। হয়ত ঘুমের মধ্যেই মারা যাবেন।
আমাদের উপর আল্লাহর যে পরীক্ষা সেটা আমরা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তার উপর নির্ভর করে, এটা নিয়তির উপর নির্ভরশীল নয়। নিয়তি কেবল আল্লাহই বদলাতে পারেন। আর তিনি এটা বদলাবেন আপনার কাজের ইন্টেনশন এর উপর ভিত্তি করে। যদি আপনার কাজের উদ্দেশ্য ভালো হয়, তাহলে আপনার নিয়তিও হবে উত্তম।তাকদিরে সব নির্ধারিত থাকলে আমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় কেন? প্রতিটা কাজের প্রতিফল দেয়া হবে নিয়ত অনুায়ী। আপনি আপনার করুণ পরিণতিকে বদলে ফেলতে পারেন আল্লাহর কাছে দুআর মাধ্যমে। আল্লাহ আপনাকে সৃষ্টি করলেও ভালো-খারাপ দুটো রাস্তার যেকোন একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণ আপনার উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। আর এখনই আপনি আপনার জন্য উত্তম পথ বেছে নিন।