সময়ের সেরা যে কজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়িয়েছিলেন গৌরবোজ্জ্বল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার মধ্যে হলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসু বা সত্যেন বোস, আরেকজন অধ্যাপক জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ হলেন রসায়নের। এছাড়াও ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী মোতাহার হোসেন এবং ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। এর মধ্যে সত্যেন্দ্র বোস নিয়ে প্রায়ই আমি লিখি। শুধু আমি না অন্য অনেকেই লিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন্দ্র বোসের নামে একটি সেন্টার আছে সেই সেন্টারের মাধ্যমে তার নামেও তাকে স্মরণ করা হয়। এই সবই হল নামকাওয়াস্তে। কিন্তু জ্ঞান চন্দ্র ঘোষকে নিয়ে তেমন কোন চর্চা হয় না। সম্প্রতি এইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন চারটি স্মরণিকা প্রকাশ করে তার একটিতে রসায়নের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নিলুফার নাহার একটি আর্টিকেল লিখেন সেখানে জ্ঞান চন্দ্রকে নিয়ে সুন্দর দুটো প্যারাগ্রাফ লিখেছেন। লেখাটির চুম্বকাংশ আর তাকে নিয়ে আমার কিছু জানা বিষয় যোগ করে এই লেখাটি।
শতবর্ষ পূ্র্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নেই বিজ্ঞান অনুষদের অন্যতম দুটি বিভাগ স্থাপিত হয়েছিল। এদের মধ্যে একটি হলো পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আর অন্যটি হলো রসায়ন বিভাগ। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে গড়ে তোলার জন্য প্রফেসর ওয়াল্টার জেনকিন্সকে বিভাগীয় প্রধান করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সত্যেন্দ্র নাথ বোসকে। আর রসায়ন বিভাগকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব হয়েছিল মেধাবী, প্রতিভাবান ও নিবেদিতপ্রাণ রসায়নবিদ ড. জ্ঞান চন্দ্র ঘোষকে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের সংস্পর্শে এসে রসায়ন শিক্ষা ও গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। জ্ঞান তাপস অধ্যাপক জে সি ঘোষ একাধারে ছিলেন একজন নিবেদিত শিক্ষক এবং দক্ষ গবেষক অন্যদিকে ছিলেন একজন দূরদর্শি সংঘঠক ছিলেন। তিনি নিজের পান্ডিত্য এবং জ্ঞানের গাম্ভীর্জ দিয়েই শুধু নয় উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে, ব্যবহারিক ক্লাস এবং গবেষনার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ক্যামিক্যালস ও রিয়েজেন্টস দিয়ে বিভাগকে সমৃদ্ধ করে একটি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন বিভাগে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমনি এমনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো না। এর কাঠামো অনেকটা অক্সফোর্ডের আদলে গড়া। শুধু আদলে না গুন এবং মানের কারণেও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। সেই গুন মান যেকজন শিক্ষক বৃদ্ধি করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সত্যেন বোস আর জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ। সতীর্থ বন্ধু সত্যেন বোসের মত জ্ঞান চন্দ্র ঘোষও বিএসসি ও এমএসসি পরীক্ষায় ১ম শ্রনিতে ১ম স্থান অধিকার করা। তিনি ভৌত রসায়নে স্ট্রং ইলেক্ট্রোলাইট ডিসোসিয়েশনের নুতন থিউরি দিয়ে ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। অধ্যাপক ঘোষের গবেষণার বিষয় ছিল ইলেক্ট্রো রসায়ন, ফটোরসায়ন, প্রাণরসায়ন এবং কৃষি রসায়ন। বোস এবং ঘোষ দুজনেই তাদের জীবনের শ্রেষ্ট সময়ের ২০ বছরের অধিক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে গেছেন। অথচ তাদের বিশেষ করে জ্ঞান চন্দ্র ঘোষকে নিয়ে কোন চর্চা হয়? সত্যেন বোসের মত জ্ঞান চন্দ্র ঘোষও এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জণ হলে বসে বিশ্বমানের গবেষণা করে বিশ্বসেরা গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করেছেন।
তারপর তিনি চলে গেলেন ভারতে। সেখানে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের এক নম্বর প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সের । তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হয়ে প্রতিষ্ঠানের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেন। তার নেতৃত্বেই এই ইনস্টিটিউট ভারতের সেরা ইনস্টিটিউটে পরিণত হওয়ার ভিত্তি রচিত হয়। গতকালকেই দেখলাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স টাইমস ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং-১ অবস্থান হলো ৩০১-৩৫০ এর মধ্যে এবং এটিই ভারতের সেরা ইনস্টিটিউট। তারপর তাকে দেওয়া হলো আইআইটি খড়গপুরের দায়িত্ব। তার নেতৃত্বেই আইআইটি খড়্গপুর সুনাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। পরবর্তীতে ঘোষ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন। ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চায় তার অবদানের জন্য তাকে দেয়া হলো নাইটহুড। সবাই তাকে চেনলো স্যার জি. সি. ঘোষ নামে। শুধু তাই না। তিনি ছিলেন এইবার বুঝুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি মাপের শিক্ষক পেয়েছিল আর ১৯৪৭-এ কি মাপের শিক্ষকদের হারালো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো গৌরব এখনো ফিরে পেতে পারে। এর শুরু হতে পারে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ এবং রসায়ন বিভাগের সামনে কার্জণ হলে যথাক্রমে সত্যেন বোস ও জ্ঞান চন্দ্র ঘোষের ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে তারা কেমন বিভাগে পড়তে আসছে। লিগেসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বের সেরা সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই তাদের সেরা বিজ্ঞানী ও স্কলারদের ভাস্কর্য দেখা পাওয়া যায়। এই ভাস্কর্য যেন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাক্ষর হিসাবে পরিণত হয়েছে। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরলে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের ছবি দেখা যায়। কোন বিজ্ঞানী বা স্কলারদের উপস্থিতি নাই। অথচ আমাদের অতীত কত সমৃদ্ধ। আশা করি আমাদের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাববে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় বানান। বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চার জায়গা। এক্সট্রা কাররিকুলার হিসাবে অন্যান্য কিছুর সাথে রাজনীতি থাকতে পারে কিন্তু সেটা হবে কেবলই ছাত্রদের জন্য রাজনীতি। বুইড়াদের রাজনীতি না।