দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এক কর্মকর্তা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন সকাল সাড়ে নয়টায়। তাঁর সিরিয়াল নম্বর ছিল ৮৯। বেলা পৌনে একটা নাগাদ তিনি পণ্য পেয়ে পাশের ফুটপাতে গাছের ছায়ায় খানেক বিশ্রাম নিলেন। এরপর একপাশে পণ্যগুলো রেখে এগিয়ে গেলেন আরেক লাইনে থাকা তাঁর সহধর্মিণীকে সহায়তার করতে। মিনিট বিশেকের মধ্যে তাঁর স্ত্রীও কাঙ্ক্ষিত পণ্য হাতে পেলেন। স্ত্রীর সিরিয়াল নম্বর ছিল ৬২।
স্বামী-স্ত্রী দুজন যখন সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া পণ্যগুলো ব্যাগের মধ্যে রাখছিলেন, তখন ফুটপাতে বসে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্ত্রী বললেন, জান (জীবন) শেষ। সাড়ে তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে এখন আর হাঁটতে পারছেন না। স্ত্রীর এমন কষ্টের কথা শুনে স্বামী বললেন, রিকশা নেব নাকি? প্রত্যুত্তরে স্ত্রীর জবাব, একটু বিশ্রাম নিয়ে হেঁটেই বাসায় যাবেন।
আজ শনিবার বেলা ১টার দিকে মিরপুর–৬ নম্বর সেকশনের ট ব্লকে ইসলামিয়া স্কুল রোডে থাকা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাকের কাছে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।রূপনগরের ট ব্লকে বড় একটি বস্তি রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ট ব্লক বস্তি নামে পরিচিত। টিসিবির ট্রাকে করে আনা পণ্যের বেশির ভাগ ক্রেতা এ বস্তির বাসিন্দা। তবে পুরুষদের মধ্যে মুখে মাস্ক পরে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। আর নারীরা এসে দাঁড়িয়েছেন বোরকা পরে।
দুদকের সাবেক যে কর্মকর্তা টিসিবির গাড়ি থেকে পণ্য নিয়েছেন, তাঁর বাসা পণ্য বিক্রির স্থান থেকে ৫০০ মিটার দূরে। তাঁর এলাকাটি অবশ্য মিরপুরের পল্লবীতে সেকশন–৬–এর ডি ব্লকে পড়েছে।নিজে পণ্য পাওয়ার পর আলাপকালে দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বললেন, বাজারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই কথা বললে আবার পেনশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন তো আরও বিপদে পড়বেন। এর চেয়ে মুখ বন্ধ রেখে কষ্ট মেনে নিচ্ছেন। কম খেয়ে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এরপর এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে আর কথা বলতে রাজি হননি তিনি। শুধু এটুকুই বললেন, তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছয়। পেনশনের টাকায় তাঁর সংসার চলছে। টিসিবির লাইনে দাঁড়ানোর আগে ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়েও পাঁচ কেজি চাল কিনেছেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই পায়ে হেঁটে বাসার উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে শহরের নিম্নআয়ের মানুষেরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টিসিবির পণ্য বিক্রি কেমন চলছে, তা সরেজমিন দেখতে এসে মধ্যবিত্তদের দুরবস্থায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হলো।ট ব্লক বস্তির পাশে টিসিবির পণ্য বিক্রির সময় দেখা গেল, আজ সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ। এই চারটি পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে ৬১০ টাকায়। এর মধ্যে তেল, চিনি ও ডাল দুই কেজি করে। আর পেঁয়াজ পাঁচ কেজি। দুই লিটার তেলের দাম পড়ছে ২২০ টাকা।
জুয়েল রানা নামের এক ব্যক্তি বনানীতে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। প্রায় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য হাতে পেয়েছেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় জেনে আর কথা বলতে রাজি হননি। তবে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, তিনি যে টাকা বেতন পান, তাতে সংসার চলছে না। একযোগে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় মহাবিপদে পড়েছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।এদিকে সকাল থেকে যাঁরা লাইনে ছিলেন, তাঁরা প্রতিটা পণ্য ঠিকমতো পেয়েছেন। তেলের চাহিদা বেশি থাকায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে আর তেল কিনতে পারেননি। শেষের দিকে যাঁরা পণ্য পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে হয় চিনি ও ডাল, না হয় ডাল আর পেঁয়াজ নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়েছে।
নিজেদের উদ্যোগে সিরিয়াল নম্বর
বিশৃঙ্খলা এড়াতে নিজেদের উদ্যোগে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়েছে ট ব্লকের এই স্থানে। রফিউদ্দিন নামের এক যুবককে লাইনে অপেক্ষমাণ লোকজনের হাতে কলম দিয়ে সিরিয়াল নম্বর দিতে দেখা গেছে।জানতে চাইলে রফিউদ্দিন জানাল, ঝামেলা এড়াতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অনেকে সিরিয়াল ভেঙে পণ্য নিতে চাইলে হট্টগোল বেধে যাচ্ছে।
টিসিবির ট্রাক আসার পৌনে এক ঘণ্টা আগে সকাল সোয়া নয়টার সিরিয়াল দিয়ে রেখেছিলেন হাসনা বেগম। এরপর ছোট শিশুকে বাসায় দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। আধা ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখেন তাঁর পরে সিরিয়াল দেওয়া লোকজনকে পণ্য দেওয়া হলেও তিনি পাচ্ছেন না। পরে চিৎকার–চেঁচামেচি করে তিনি পণ্য নেন। গর্ভবতী ও বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক নারীকেও লাইনে দাঁড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির পণ্য নিতে দেখা গেছে।টিসিবির ট্রাকে সকাল থেকেই পণ্য প্যাকেটে ভরার কাজ করছেন আরিফ নামের এক তরুণ। তিনি জানান, আজ ৫০০ লিটার তেল, ১ হাজার কেজি পেঁয়াজ এবং চিনি ও ডাল ৫০০ কেজি করে আনা হয়েছে। ২৫০ জনকে পণ্য দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে এসব পণ্য আনা হয়েছে। প্রতিনিয়ত মানুষের চাপ বাড়ছে বলেও জানান আরিফ।
দুপুর দেড়টার দিকে সরেজমিন আরও দেখা যায়, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার লোকজনের সংখ্যা ছিল শতাধিক। শেষমুহূর্তে সেকশন–৭–এর মিল্ক ভিটা এলাকা থেকে দৌড়ে টিসিবির এই ট্রাকের কাছে এসেছিলেন আসমা বেগম। পণ্য না পেয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে কোথায় গেলে পণ্য পাওয়ার যাবে, তা ইন্টারনেট দেখার অনুরোধ করেন। এ সময় পাশে থাকা এক ব্যক্তি ওই নারীকে বললেন, সাধারণত দুপুর পর্যন্ত কোথাও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পাওয়া যাবে না। আশপাশের এলাকায় খবর নিয়ে সকাল সকাল লাইনে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হলো তাঁকে।
এ ট্রাকের চালক আবদুল হালিম সকাল থেকে পণ্য বিক্রির মূল দায়িত্বে ছিলেন। সব পণ্য বিক্রি শেষে বেলা ২টা ১০ মিনিটে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তবে লোকজনের চাপ অনেক বেশি। তাঁরা আড়াই শ জনের পণ্য নিয়ে আসেন। কমবেশি ৪০০ জন এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। টিসিবির পণ্যগুলোর মধ্যে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩০ টাকা, চিনি ৫৫, ডাল ৬৫ ও প্রতি লিটার তেল ১১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।