ইসলাম মুসলিমদের জামাতে সালাত আদায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। মুসলিমদের দৈনিক ৫ ওয়াক্ত ফরজ সালাত আদায় করতে হয়। এগুলো মসজিদে আদায়ের জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। ফরজ সালাত মসজিদে আদায়ে রয়েছে অসংখ্য ফজিলত।
আমরা এই লেখায় জামাতে সালাত আদায়ের কিছু ফজিলত জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
একাকী পড়ার চেয়ে জামাতে সালাত আদায়ে ২৭ গুণ বেশী সাওয়াব
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ صَلاَةُ الْجَمَاعَةِ أَفْضَلُ مِنْ صَلاَةِ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً ”
ইবনু উমার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
জামাআতে সালাত আদায় করার মর্যাদা একাকী সালাত আদায়ের চাইতে সাতাশ গুন বেশী। [সহিহ মুসলিমঃ ১৩৫২
আমরা যদি আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের জীবনের দিকে অর্থাৎ সিরাতের দিকে তাকাই তাহলে আমরা অবশ্যই দেখতে পাব যে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীগণ কখনই মসজিদে জামাতে নামায ত্যাগ করতেন না। তারা সর্বদা ফরজ সালাত মসজিদে আদায় করতেন। তবে কিছু কিছু বিপন্ন পরিস্থিতিতে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। যেমন, মহামারী পরিস্থিতি, ভারী বৃষ্টি এবং যদি কখনও মসজিদে নামাজ পড়া খুব বিপজ্জনক বা খুব অসুবিধাজনক হয়। কেবল সে ক্ষতেরে তারা জামাতে নামাজ আদায় থেকে বিরত থেকেছেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ، قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا الصُّبْحَ فَقَالَ ” أَشَاهِدٌ فُلَانٌ ” . قَالُوا لَا . قَالَ ” أَشَاهِدٌ فُلَانٌ ” . قَالُوا لَا . قَالَ ” إِنَّ هَاتَيْنِ الصَّلَاتَيْنِ أَثْقَلُ الصَّلَوَاتِ عَلَى الْمُنَافِقِينَ وَلَوْ تَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لأَتَيْتُمُوهُمَا وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الرُّكَبِ وَإِنَّ الصَّفَّ الأَوَّلَ عَلَى مِثْلِ صَفِّ الْمَلَائِكَةِ وَلَوْ عَلِمْتُمْ مَا فَضِيلَتُهُ لَابْتَدَرْتُمُوهُ وَإِنَّ صَلَاةَ الرَّجُلِ مَعَ الرَّجُلِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ وَحْدَهُ وَصَلَاتُهُ مَعَ الرَّجُلَيْنِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ مَعَ الرَّجُلِ وَمَا كَثُرَ فَهُوَ أَحَبُّ إِلَى اللهِ تَعَالَى ” .
উবাই ইবনু কাব রাদিআল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে ফজরের সালাত আদায় করার পর বললেনঃ অমুক হাযির আছেন কি? সাহাবীগণ বললেনঃ না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ দুই ওয়াক্ত (ফজর ও ’ইশা) সালাতই মুনাফিকদের জন্য বেশি ভারী হয়ে থাকে। তোমরা যদি এই দুই ওয়াক্ত সালাতে কি পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে তা জানতে, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তোমরা অবশ্যই এতে শামিল হতে। জামাআতের প্রথম কাতার মালায়িকাহর (ফিরিশতাদের) কাতারের সমতুল্য। তোমরা যদি এর ফাযীলাত সম্পর্কে জানতে, তাহলে অবশ্যই তোমরা এজন্য প্রতিযোগিতা করতে। নিশ্চয় দু’জনের জামা’আত একাকী সালাত আদায়ের চেয়ে উত্তম। তিনজনের জামা’আত দু’জনের জামা’আতের চেয়ে উত্তম। জামাআতে লোক সংখ্যা যত বেশী হবে মহান আল্লাহর নিকট তা ততই বেশি পছন্দনীয়। [সুনানু আবু দাউদঃ ৫৫৪]
শয়তান থেকে সুরক্ষা
قَالَ قَالَ لِي أَبُو الدَّرْدَاءِ أَيْنَ مَسْكَنُكَ قُلْتُ فِي قَرْيَةٍ دُوَيْنَ حِمْصَ . فَقَالَ أَبُو الدَّرْدَاءِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ “ مَا مِنْ ثَلاَثَةٍ فِي قَرْيَةٍ وَلاَ بَدْوٍ لاَ تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلاَةُ إِلاَّ قَدِ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَعَلَيْكُمْ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ الْقَاصِيَةَ ” . قَالَ السَّائِبُ يَعْنِي بِالْجَمَاعَةِ الْجَمَاعَةَ فِي الصَّلاَةِ .
মাদান ইবনু আবূ তালহা ইয়া’মুরী রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূদ-দারদা রাদিআল্লাহু আনহু আমাকে বললেনঃ তোমার বাড়ি কোথায়? আমি বললামঃ আমার বাড়ি হিমসের নিকটবর্তী এক গ্রামে। তখন আবূ-দারদা বললেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে শুনেছি, কোন গ্রামে অথবা অনাবাদী স্থানে তিনজন লোক থাকাবস্থায় সেখানে সালাত প্রতিষ্ঠিত না হলে তাদের উপর শয়তানের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। অতএব তোমরা জামাতকে অত্যাবশ্যকীয়রূপে গ্রহণ করবে। কেননা বাঘ বিচ্ছিন্ন ছাগলকে খেয়ে ফেলে। সায়িব রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ জামাআত অর্থ সালাতের জামাআত। [সুনানু নাসায়িঃ ৮৪৮]
আত্মীয়তা ও বৈবাহিক সম্পর্ক ভালো থাকে
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সলাত আদায়ের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। সূরা আল-বাকারার পারিবারিক সম্পর্ক এবং বৈবাহিক বিষয় সম্পর্কিত আয়াতের মাঝখানে (অর্থাৎ আয়াত 223-242) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন:
حٰفِظُوۡا عَلَی الصَّلَوٰتِ وَ الصَّلٰوۃِ الۡوُسۡطٰی ٭ وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰهِ قٰنِتِیۡنَ ﴿۲۳۸﴾
তোমরা সালাতসমূহ ও মধ্যবর্তী সালাতের হিফাযত কর এবং আল্লাহর জন্য দাঁড়াও বিনীত হয়ে। [সুরা বাকারাঃ ২৩৮]
সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিষয় বর্ণনা করার পর সালাতের তাকীদ দিয়ে আল্লাহ এ ভাষণটির সমাপ্তি টানছেন। কারণ, সালাত এমন একটি জিনিষ যা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয়, সততা, সৎকর্মশীলতা ও পবিত্রতার আবেগ এবং আল্লাহর বিধানের আনুগত্যের ভাবধারা সৃষ্টি করে আর এ সঙ্গে তাকে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখে। মানুষের মধ্যে এ বস্তুগুলো না থাকলে সে কখনো আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে অবিচল নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারত না।
কতিপয় হাদীসের প্রমাণ অনুসারে অধিকাংশ আলেমের মতে মধ্যবর্তী সালাতের অর্থ হচ্ছে আসরের সালাত। কেননা, এর একদিকে দিনের দুটি সালাত – ফজর ও যোহর এবং অপরদিকে রাতের দুটি সালাত – মাগরিব ও এশা রয়েছে। এ সালাতের জন্য তাকীদ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, অনেক লোকেরই এ সময় কাজকর্মের ব্যস্ততা থাকে। আসরের সালাতের গুরুত্ব বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার আসরের সালাত ছুটে গেল তার যেন পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদ সবই ধ্বংস হয়ে গেল। [সহিহুল বুখারীঃ ৫৫২]
শায়খ ড. ওয়াহবাহ আজ-জুহাইলি বলেছেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কেন পারিবারিক সম্পর্ক সম্পর্কিত আয়াতের মধ্যে আমাদের সালাতকে হিফাজত করার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন সেটার সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, সলাত পরিবারের সদস্যদের যেমন স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের সম্পর্কে খারাপ চিন্তাভাবনা থেকে রক্ষা করে এবং তাদের সকল প্রকার মন্দ থেকে রক্ষা করে, শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচায়। তারা এ বিষয়ে সতর্ক না হলে এটি পারিবারিক এবং বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে।
পরিবারের সদস্যরা জামাতে সালাত আদায় করলে এটি তাদের শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে দূরে রাখবে। তদ্ব্যতীত, জামাতে সালাত সামাজিকতা বজায় রাখতে এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষায় উত্সাহিত করে। কারণ আমরা প্রত্যেক সালাতের পর একে অপরকে সালাম জানাই। এটি শত্রুতা ও ঘৃণার আগুনকে নিভিয়ে দেয়। আমাদের হৃদয়কে রাহমাহ (রহমত) এবং ইহসান (সহানুভূতি) দিয়ে পূর্ণ করে। একে অপরের প্রতি সহানুভূতির জন্ম দেয়।
আমরা যদি নিয়মিত জামাতে সালাত আদায় করতে থাকি, তাহলে আল্লাহ তো আমাদের অগণিত পুরষ্কার দেবেনই। পাশাপাশি আমরা পরিবারের বন্ধন টিকিয়ে রাখতে পারব। ইনশাআল্লাহ শয়তানের প্ররোচনা থেকেও নিজেদের দূরে রাখতে পারব।
জামাতে সালাত আদায়ের পুরো সময় ধরে সাওয়াব অর্জন করা যায়
শায়খ দাউদ আল-ফাথানির মতে, একাকী সালাত আদায়ের সময় বান্দা কেবল যেটুকু সময়ে খুশু অবলম্বন করবে কেবল সেটার জন্য সাওয়াব দেওয়া হবে।
কিছু যারা জামাতে সালাত আদায় করবে, তারা যখন খুশু পুরোপুরি বজায় রাখতে পারবে না পুরো সালাত জুড়ে, তবুও তাদেরকে পুরো সালাতের সাওয়াবই দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
আসুন আমরা জামাতে সালাদ আদায়ের সুযোগ গ্রহণ করি। আমাদের প্রিয়জনদের সাথে জামাত নামাজ আদায় করে আমাদের ঘর আলোকিত করি। যে ঘর সালাতের দ্বারা প্রজ্বলিত হয় সেই ঘরটিই বরকতময় ঘর, ইনশাআল্লাহ।
সূত্র
১ আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া বিন সিরাফ আন-নওয়াভী, ৬৭৬ হি. রিয়াদুস সালিহিন
২ আবু আল-মাওয়াহিব আবদুল ওয়াহহাব বিন আহমদ আল-সায়রানী, ৯৭৩ হি. আল–মিনাহ আস–সানিয়াহ আলা আল–ওয়াসিয়াতি আল–মাবতুলিয়্যাহ। বৈরুত; দারুল-কুতুব আল-ইলমিয়াহ।
৩ আবু দাউদ সুলায়মান বিন আশআত আল-আজাদী আল-সিজিস্তানি, ২৭৬ হি. সুনান আবি দাউদ
৪ ওয়াহবাহ মুস্তফা আল-জুহাইলি, ১৪৩৫ হি. তাফসীর আল-মুনির, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৭৬৩-৭৬৭। সিরিয়া; দারুল-ফিকর।
৫ দাউদ আবদুল্লাহ আল-ফাতানি, ১২৬৫ হি. মুনিয়াতুল মুসাল্লি, পৃষ্ঠা ১২২। মালয়েশিয়া; তেলাগা বিরু পাবলিকেশন।