ছোট্ট সোনামণিদের হজ্জ ওয়ার্কশপের বর্ণনা।
প্রতিবছর যিলহজ্জ মাসে আমাদের মসজিদে জমজমাট আয়োজন হয় বাচ্চাদের হজ্জ ওয়ার্কশপের দিন! একদম ৫-১৫ বছর বয়সী ছোট্ট ছোট্ট ময়না পাখিরা দলবেঁধে মসজিদে চলে আসে। তাদেরকে পুরো ওয়ার্কশপ জুড়ে গাইড করার জন্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে “সামলানোর” জন্য রেডি থাকে দক্ষ ইসলামিক স্কুলের টিচারগুলো।
ওয়ার্কশপের দিন মসজিদের ভেতরে ঢুকেই দেখি ছোট বাচ্চাদের কিচিরমিচিরে পুরো বিল্ডিং গমগম করছে! সুনিপুণ দক্ষতার সাথে সর্বমোট আটটা স্টেশন সাজানো হয়েছে পুরো মসজিদের মুসল্লা জুড়ে।
কার্ডবোর্ড বক্সে কালো রঙের আর্ট-পেপার সেঁটে দেয়া কাবাঘরের মডেল দেখা যাচ্ছে! ঠোঙা টাইপ শক্ত কাগজ গুলো দুমড়ে-মুচড়ে বানিয়েছে সাফা এবং মারওয়া পাহাড় — দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়ে দৌড়ে সাঈ করার জন্য বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সাদা চাদর! মিনার স্টেশনে সাদা কাপড় দিয়ে তাঁবু টানানো হয়েছে; মুজদালিফায় নামাজ পড়ার জায়নামাজ বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে! শয়তানকে পাথর দেওয়ার “আল-জামারাত” করার জায়গাটাও কীভাবে যে বানিয়েছে সুবহানআল্লাহ! আরাফাতের ময়দানে গিয়ে দুই হাত তুলে দুয়া করার উপকরণ সাজানো হয়েছে। কুরবানী করার জন্য সেখানে খেলনা ভেড়া পর্যন্ত রাখা আছে! নিচের ছবি গুলো দেখে দেখে আপনারাও ঘুরে আসুন স্টেশন থেকে স্টেশনে, মজা পাবেন!
বর্ণাঢ্য ওয়ার্কশপ শুরু হয় বাচ্চাগুলোকে অল্প কথায় হজ্জ সম্পর্কে জানানোর মাধ্যমে। ও আল্লাহ! এতগুলো কারিমুনিকে এক জায়গায় জড়ো করে খুতবা শোনানো চাট্টিখানি কথা নয়! কেউ শুনতে-শুনতে মাটিতে শুয়ে পড়ছে, কেউ দিব্যি পাত্তা না দিয়ে বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ ইচ্ছামত হাসাহাসি করছে, কেউ শুধু শুধু কোন কারণ ছাড়াই বারবার হাত তুলছে!! পাহাড় সমান ধৈর্য নিয়ে একেকজন ভলেন্টিয়ার এবং মেন্টর পরম আদর, ভালোবাসা এবং ডিসিপ্লিন দিয়ে বাচ্চাগুলোর তদারকি করে যাচ্ছে। উম্মতের ভবিষ্যৎ বলে কথা!
সবাইকে টিমে ভাগ করে দেয়া হলো! টুকুর টুকুর করে একেক জন বাচ্চা সাফা থেকে মারওয়া পাহাড়ে দিল দৌড়!! টিচার বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে “এখানে আমরা কিন্তু দৌড় প্রতিযোগিতায় নামতে আসি নি … আস্তে বাচ্চারা! আহারে আস্তে আস্তে দৌড়াও !! মা হাজেরাকে স্মরণ করো, তার গল্প যে বলেছিলাম ক্লাসে মনে আছে না?” টিচার গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে, কে শোনে কার কথা?
সবচেয়ে মজার দৃশ্য ছিল শয়তানকে পাথর মারা!! সত্যিকারের পাথর তো আর এই ক্ষুদে বাহিনীর হাতে দেয়া যায় না! ডেঞ্জারাস ব্যাপার হয়ে যাবে! টিচাররা প্রত্যেক টিমের বাচ্চাদেরকে হাতে ছোট ছোট রংবেরঙের তুলার টুকরা (পম্ পম্) ধরিয়ে দিল, এগুলোই তাদের পাথর! এরপর বলা হলো শয়তানকে ছুড়ে মারো। একেকটা বাচ্চা এমন ভাবে পাথর মারছে যেন এই মুহূর্তে শয়তানের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবে সুবহানাল্লাহ! সব টিম পাথর মেরে যখন পরের স্টেশনে যাবে, তখন দেখি মোটামুটি বড়োসড়ো দেখতে বাচ্চাটা এক লাথি দিয়ে পিলারটাই ফেলে দিল!! মসজিদে বসে এই দৃশ্য দেখে আর আমি আর আম্মা না হেসে থাকতে পারলাম না !!
তবে আরাফাতের ময়দান স্টেশনের অ্যাক্টিভিটিটা ছিল হৃদয়গ্রাহী! আমার চোখে পানি ধরে আসলো যখন আরাফাতের স্টেশনে গিয়ে ইমাম দুয়া করতে বসলেন। সব বাচ্চাগুলোকে অনুরোধ করলেন হাত ওঠাতে। ছোট্ট একেকটা মানিক! কি যে হচ্ছে চারপাশে, বেশিরভাগ হয়ত তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে! যদিও পাকনা বুড়াবুড়ি এক একজনের না বোঝার কোন কারণ নাই! তাও তাদের দুই হাত তুলে আল্লাহকে ডাকার সেই দৃশ্য ভোলার না! খেলতে খেলতে হজ্জ শেষ করার মাধ্যমে একেকজনের সে কি আনন্দ!
এভাবেই এক উৎসব মুখর পরিবেশের মাধ্যমে আমাদের মসজিদে ছোট বাচ্চাদের জন্য হজ্জের ওয়ার্কশপ সম্পন্ন হলো আলহামদুলিল্লাহ! এর উদ্দেশ্য একটাই: ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মনে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করা। হাসতে, খেলতে আনন্দ করতে করতে তারা যেন ইসলামকে ভালোবেসে বড় হয়। এভাবে ছোটবেলায় যদি আনন্দে আনন্দে আমরা হজ্জ শিখতাম, ইসলাম কি সেটা চিনে ফেলতাম, তাহলে হয়তো বড় হয়ে আমরা ভিন্ন রকম মানুষ হতাম।
এই দুনিয়ার মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে কত রকম কাজ তো আমরা করি, তাই না? তাহলে আখিরাতের জন্য কেন করব না? আমরা ক্রিয়েটিভ এবং সক্রিয় না হলে, এই বাচ্চাগুলোর আদৌ ভবিষ্যতে নিজেদেরকে মুসলিম পরিচয় দিবে কিনা তার কোন গ্যারান্টি নেই। আইডিয়া গুলো শেয়ার করুন। কারো না কারো চোখে তো পড়েই যাবে!
সামনে তো আসছে পবিত্র জিলহজ্জ মাস! আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। সেই জিলহজ্জের প্রথম দশদিনের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মৌসুম!
করোনাভাইরাসের সময় হজ্জ-ওমরাহ বন্ধ ছিল। কত অন্তর কাঁদছে সেই দিন থেকে একটা বার আল্লাহর ঘর দেখার জন্য! আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর স্বীয় রহমতে আবার দরজাটা খুলে দিয়েছেন আমাদের মতো গুনাহগারদের জন্য।
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজীরা আবার বাইতুল্লাহয় একত্রিত হবে আলহামদুলিল্লাহ। লক্ষ লক্ষ বিশ্বাসীরা এক সুরে বলবে, “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক … আমি হাজির ইয়া আল্লাহ আমি হাজির ….”
আমার শরীরটা চার দেয়ালের মাঝে থাকলে কি হবে, মনটা পড়ে আছে মক্কার কাবার চত্বরে, প্রিয় রাসূল (স) শহর মদিনাতে … লিখতে লিখতেই অন্তর মোচড় দিলো।
ছোট্ট সোনামণিদের হজ্জ ওয়ার্কশপের কাণ্ডকীর্তি দেখে হাসতে হাসতে এই তৃষ্ণা আরো বহুগুণে বেড়ে গেল …
হে আল্লাহ, ইয়া ফাত্তাহ, আপনি তো আল-ওয়াহহাব!! আমাদেরকে হজ এবং ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে আপনার ঘরের মেহমান করে নিয়ে যান। আমিন।
________
আমার মসজিদ ডায়েরী
পর্ব ৭
১২ জিলকদ ১৪৪৩