খুব কম বয়স থেকেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তা হলো, আমাকে চূড়ান্ত রকমের একা হতে হবে। প্রকৃত কিছু করতে গেলে, আমাকে আমার মতো হতেই হবে, নিখুঁত। প্রকৃত শিল্প তা-ই— যা কেবল একজন শিল্পীর মনমতো হওয়াটাই মূখ্য। ভ্যান গগ আপনার ভালো লাগলো কিনা, আপনি দেখলেন কিনা— তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি তারকোভস্কি দেখলেন কিনা, আপনার কেমন লাগলো, সেসব কোনো বিষয়ই না। একজন শিল্পী তা-ই করবে, যা করে সে আনন্দ পাবে।
এই সত্যিকারের আনন্দের খোঁজ যে শিল্পী পেয়ে যায়, তাকে আর কোনোভাবেই ফেরানো যায় না। সে অসীমের দেখা পেয়ে যায়। তাকে হয়তো ধরা যাবে, কিন্তু ছোঁয়া যাবে না। আবার হয়তো ছোঁয়া যাবে, কিন্তু ধরা যাবে না।
আমি খুব কম বয়স থেকেই যে বিষয়টা দেখে এসেছি, যে বা যারা নতুন কিছু নিয়ে এসেছে, তাদের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আগ্রহ কম। কারণ, এই অধিকাংশ মানুষেরা নতুন কিছু নিতে অক্ষম। নিজেদের অভ্যেসের বাইরে তারা যেতে পারেনি কোনোদিন। আর যে বা যারা নতুন কিছু নিয়ে আসে, তারা যদি সেই নতুন কিছু করে পর্যাপ্ত আনন্দ পায়, তাহলে শুধু অধিকাংশ সংখ্যাটাই নয়, সকলেও যদি তাদেরকে না দেখে, না শোনে, না বুঝতে পারে, তাহলেও তা কোনো বিষয়ই নয়।
কারণ, একজন শিল্পী যে আনন্দ, যে শান্তির জন্য সারা পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে, সেই শান্তি তো তার সৃষ্টির ভেতরেই রয়েছে। আর কোত্থাও নয়। ভ্যান গগ কেউ দেখেনি, গঁগা যেমন, জীবনানন্দ কেউ পড়েনি। স্টকার কতজন মানুষ দেখে?
তাই বলে তো ভ্যান গগ কোনোদিন থেমে যাননি। বরং নিজের সেই আনন্দটুকুর পেছনেই চিরকাল একভাবেই ধ্যানরত ছিলেন। একজন প্রকৃত শিল্পীর কাজই তাই। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
কবীর সুমন যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা তো বুঝতে পারেনি মানুষ। এখানে মানুষ বলতেই অধিকাংশ মানুষ। আমি কবীর সুমনের ‘তুমি আসবেই আমি জানি’ গানটা অনেক পরে শুনেছি। এই গানটা শোনার পর, এই সাতশো কোটির পৃথিবীতে আমি আরো বেশি একা হয়ে পড়েছি। এই গানের ওজন তো পৃথিবী নিতে পারছে না।
কিয়ারোস্তামির ‘টেস্ট অফ চেরি’ দেখার পর— স্বাধীনভাবে যে শান্তির নিঃশ্বাসটুকু নিচ্ছিলাম— আমি কোনোদিন ভুলবো না তা। কোনোদিন না। কিয়ারোস্তামি কীভাবে পারলেন এমন চিন্তা করতে? আমি সারাজীবন এটা ভাবতে থাকবো। ঠিক একই জিনিস পাই যখন দেখি জদোরোয়োস্কি, যখন দেখি বার্গম্যান, যখন দেখি বেলা তার।
আবার এই একই জিনিস পাই ক্লাউড মনেটের চিত্রের গভীরে যখন যাই। পিকাসো নিয়ে যখন বসি। ভ্যান গগের গভীরতার ভেতরে যখন ঢুকে পড়ি। ফ্রিদা’র একটা কথা আমার মনে পড়ে, “I paint self-portraits because I am so often alone, because I am the person I know best.” এরপর কেবল চুপ থাকা..
সীড ব্যারেটের কথা মনে করে, কতগুলো রাত আমি কেঁদেছি, তার কোনো হিসেব নেই। কোহেন আমাকে কতটা সঙ্গ দিয়েছে, তা তো কোনোভাবেই বলে শেষ হবে না। ক্ল্যাপটনের গান শুনে, আমি সারাটা দিন একভাবে কাটিয়ে দিয়েছি, এমন অনেক দিন ছিলো। গিলমোরের কথা নাহয় না-ই বললাম। ইন গোয়ান রিং, বির্চ বুক, ম্যাট এলিয়টও আমাকে দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছে, দিচ্ছে কোহেনের মতো।
এই সকলের ভেতরে আমার যে পরিভ্রমণ— এতে আমি যা শিখলাম, তা হলো— প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ আলাদা এবং সকলেই নিজেদের মতো। ঠিক যেমন, ইয়েটস ছিলেন। যেমন ছিলেন এমিলি ডিকিনসন, ফ্রস্ট, নেরুদা..
এখানেই আমি ডিলানের নাম বলবো। কেননা, ডিলান তো প্রথমত একজন কবি। ডিলান যে প্রশ্ন করেছেন আমাকে, “কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?” — এমন প্রশ্ন তো কেউ কোনোদিন করেনি আমাকে। ডিলানের ‘হার্ড রেইনস গনা ফল’ গানটা যখন আমি শুনেছিলাম প্রথম, আমিও কবীর সুমনের মতোই পথ খুঁজছিলাম। আমি পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পৃথিবীতে এমন একটা গান, এমন করে কেউ ভাবতে পারে, আমি কোনোদিন জানতাম না। ডিলান আমাকে সম্পূর্ণ বদলে দিলো।
নর্দমায় যাদের গলা অব্ধি ডুবে আছে— তারা নীৎসে পড়বে কখন? তারা সুমনের গান শুনবে কখন? তারা ভিঞ্চি নিয়ে বসবে কখন? ওইযে বলেছিলাম, যেখানে নতুন আছে, সেখানে অধিকাংশ মানুষ নেই। আর এতে কিচ্ছু যায় আসে না। স্টকার কেউ না দেখলেও সেটা পৃথিবীর সম্পদ ছিলো, আছে, থাকবে।
তারকোভস্কি একবার বলেছিলেন, “সবাই আমাকে বুঝুক, এই ব্যাপারটা আমাকে কাছে খুব অপরিহার্য নয়। বরং সবাই আমাকে বুঝবে না, এই ব্যাপারটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” কী দারুণ! তারকোভস্কি আমাকে যেন গড়ে তুলেছেন। তিনি এক এবং ঈশ্বরের ছায়ায় বেড়ে ওঠা একজন মানুষ।
আমি কবিতা লিখি। কারণ, আমার ক্ষত এবং শূন্যস্থানকে আমি আরো বেশি জোরালো এবং নিখুঁত করতে চাই। এবার এই চাওয়াটা তো সম্পূর্ণই আমার। তাহলে একটি কবিতা লেখার পরে, আমি যে শান্তিটুকু পাই, তা তো অন্য কেউ আমাকে দিচ্ছে না, দিতে পারবেও না কোনোদিন। গিলমোরের ‘Then I Close My Eyes’ শুনে যে শান্তিটুকু পাই, তা তো কোনোদিন কোনো কাছের মানুষ আমাকে দিতে পারেনি।
এবার আমার কবিতা কে পড়লো, কে কী বললো, তা এতটাই অর্থহীন এবং অগুরুত্বপূর্ণ— যতটা অর্থহীন কবিতাকে ব্যাখ্যা করা। কবিতার ব্যাখ্যা হয় না। কবিতার ব্যাখ্যাই হচ্ছে কবিতা।
আমার কাছে একজন একা মানুষকে যতটা শক্তিশালী মনে হয়, ততটা দূর্বল মনে হয় একজন টাকাওয়ালা চিন্তাগত গরীবকে। ততটা দূর্বল একজন জনপ্রিয় কুরুচিবোধসম্পন্ন মানুষ। যা অসুন্দর, তা-ই জনপ্রিয় হওয়া সহজ। যা সুন্দর, তার ওজন অতি সাধারণ রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ নিতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক।
যে নিজের মতো হতে চায়, সে অন্য কারো মতো হবে না। সে সকলের থেকে অবশ্যই শিখবে। কিন্তু কারো মতো সে হবে না কোনোদিনই। এটাই শক্তি।
আজ যা কিছু সমর্থিত হচ্ছে, বিনোদন বলে গ্রহণ করছে অধিকাংশ মানুষ, এসব তো টিকবে না কোনোদিনই। এসব হচ্ছে মৃত্যু পরবর্তী একজন প্রতিবেশীর শোকের আয়ুর সমান। অথচ তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’ এমন একটি সিনেমা, যা কিনা পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ মৃত্যু অব্ধি থাকবে। কারণ ‘নস্টালজিয়া’ গভীর। সহজ না।
সহজ, সস্তা, দূর্বল কোনো কিছুই টিকে থাকে না বেশিদিন। এখন যার চর্চা চলছে খুব। ঠিক যেমন মানুষ ভাবে, সে মৃত্যুর পরে কবরে নিয়ে যাবে তার ব্যাংক একাউন্টের সমস্ত টাকা। অন্যের জমি দখল করে তার সমস্ত কিছু নিয়ে যাবে তার কবরে।
Reporter: Khairunnesa Takia