কখনো কখনো ব্যক্তিগত কাজের চাপে আশপাশে ঘটে যাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও কেমনভাবে যেন চোখ এড়িয়ে যায়। এভাবেই চাকরিতে প্রবেশ করার পরীক্ষাসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম নামের একটি প্ল্যাটফর্মের আন্দোলন ঘিরে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেছে, তা আমার নজরে আসেনি। দুই দিন আগে আন্দোলনকারী একজন আমাকে ফোন করে বলেন যে একটি বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি ঢাকার বাইরে থাকার কারণে দুই দিন পরে তাঁদের আমার সঙ্গে দেখা করতে বলি। তাঁদের কাছে ফোনে শুনেছিলাম আন্দোলনরত অবস্থায় তাঁরা নানা রকম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। তাই তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের অবস্থার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন।
সাক্ষাতে তাঁদের কাছে জানতে পেলাম দীর্ঘদিন ধরে এই বেকার মানুষগুলো দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, কোভিডের ভয়াল থাবা অন্য সব সেক্টরের মানুষের মতো তাঁদেরও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ, বিগত ২০২০ সালের মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় সব সরকারি চাকরির সার্কুলার ও একই সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়া। করোনা পরিস্থিতির জন্য গত দেড় বছরে হাতে গোনা কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, যার অধিকাংশই আবার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে এবং ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারির মতো কয়েকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত সেপ্টেম্বর অবধি।
ফলে দেখা গেছে, এই প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীরা তাঁদের জীবনের প্রায় দুই বছর হারিয়ে ফেলেছেন কোথাও চাকরিতে প্রবেশের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পাওয়া অবস্থায়। এর সঙ্গে অবধারিত অনুষঙ্গ হিসেবে আছে দুর্নীতি আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের উপদ্রব।এই যুবকদের মতে, একই দিনে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা এবং সম্মিলিত গুচ্ছের ভিত্তিতে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করার বিধান থাকায় তাঁরা কয়েকটি সেক্টরে তাঁদের ভাগ্য পরীক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে তাঁরা সব চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো, নিয়োগ–দুর্নীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষার বিধান পরিবর্তন করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমগুলোতে এসব বিষয়ে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলন করে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। দেশের শীর্ষ তালিকার সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছে তাঁদের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। মন্ত্রী পর্যায় থেকে অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এমনকি যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাদের কাছেও তাঁরা আবেদন জানিয়েছেন।
তাঁরা কেউ কোনো গঠনমূলক কথা তো দূরের কথা, কোনো আশ্বাসবাণীও শোনাননি। তাঁদের কারও কারও পরামর্শ ‘আপনারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন’। আমার প্রশ্ন, তাহলে অন্যরা বিভিন্ন অবস্থানে ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন কেন? তা ছাড়া সাধারণ নাগরিকের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো কি মুখের কথা?এই যুবগোষ্ঠীর কয়েকজন নারী সদস্য আমাকে বলেছেন যে পুলিশ নারী ও পুরুষ উভয়েই—তাঁদের এমনভাবে লাঠিপেটা এবং আঘাত করেন, যা চরম অত্যাচারী বাহিনীকেও হার মানায়। নিজের দেশের পুলিশের হাতে এমনভাবে নিগৃহীত হওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না।যাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁরা এই চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগপ্রার্থীদের ছোট একটি দল। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পেলাম তাঁরা বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তাঁরা ২০২০ সাল থেকে অপেক্ষা করে আছেন পরীক্ষা দিয়ে যোগ্য প্রমাণিত হলে তাঁদের চাকরিজীবন শুরু করবেন।
জীবনযাপনের বাস্তবতায় তাঁরা টিউশনি বা অন্যান্য ছোটখাটো পেশার ফাঁকে ফাঁকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে স্থায়ী চাকরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কোভিড অতিমারির কারণে কর্তৃপক্ষের দিক থেকে নিয়োগ বন্ধ অথবা সীমিত করার কারণে নির্ধারিত বয়সসীমা ও চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এমন যুবকের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। যেখানে জনসংখ্যার অনুপাতে যুবা বয়সের জনগোষ্ঠীর সুবিধা নিয়ে আমরা এত আশাবাদী, সেখানে তাঁদের বিশাল এক অংশকে তঁাদের পছন্দমতো কর্মক্ষেত্রে ‘ক্যারিয়ার’ গড়ে তোলার প্রাথমিক সুযোগটাই হরণ করে নেওয়া যুক্তিসংগত হতে পারে কি?
তাঁদের যে পরীক্ষা দেওয়ার বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, সেটা তো তাঁদের কোনো দোষে নয়, তাঁদের কোনো গাফিলতিতে নয়। বিশেষ বাস্তবতায় তাঁদের চাকরিতে প্রবেশের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ, যেটা তাঁদের অধিকারও বটে, সেটা রাষ্ট্রই তাঁদের দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন রাষ্ট্রেরই এটা নৈতিক দায়িত্ব, যাতে এই সুযোগ ও অধিকার ফিরে পায়, সেটা নিশ্চিত করা। এসব দাবির সঙ্গে সবাই একমত না–ও হতে পারেন, সরকারের কাছে সবটা গ্রহণযোগ্য না–ও হতে পারে।
কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে দমনমূলক পন্থায় তা নস্যাৎ করে দেওয়া যায়। আলোচনার মাধ্যমে যতটা সম্ভব এই অধিকার ও সুযোগ তো তাঁদের দিতেই হবে।একটা সময়ে এই যুবগোষ্ঠী যখন তাঁদের উপরিউক্ত দাবিদাওয়া নিয়ে নানা কর্তৃপক্ষ ও নেতাদের কাছে ধরনা দিতে দিতে অসফল হয়ে রাস্তার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন, তখন তাঁরা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। অথচ কর্তৃপক্ষেরই কেউ কেউ তঁাদের বলেছেন যে এই বিষয়ের পক্ষে যে জনমত আছে, সেটা দেখাতে হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে যখন চাকরিপ্রত্যাশী যুবগোষ্ঠীর ব্যানারে তাঁরা মানববন্ধনের মতো অত্যন্ত নিরীহ, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন থেকেই তঁাদের ওপর পুলিশ চড়াও হতে থাকে। তাঁদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করে। গত বছরের ডিসেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারিতে তঁাদের ওপর যে ধরনের পুলিশি হামলা চালানো হয়, তা একটা গণতান্ত্রিক সরকার বলে দাবিদারদের শাসনামলের জন্য রীতিমতো লজ্জাজনক এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে বাণী আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশ পরিচালনার প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় ঘোষণা করা হচ্ছে—সবকিছু এত মূল্যহীন তাঁর অনুসারীদের কাছেই এবং তাঁদের পরিচালিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে?
এই যুবগোষ্ঠীর কয়েকজন নারী সদস্য আমাকে বলেছেন যে পুলিশ নারী ও পুরুষ উভয়েই—তাঁদের এমনভাবে লাঠিপেটা এবং আঘাত করেন, যা চরম অত্যাচারী বাহিনীকেও হার মানায়। নিজের দেশের পুলিশের হাতে এমনভাবে নিগৃহীত হওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। ভাবতে অবাক লাগে এই পুলিশ বাহিনী সেই পুলিশ বাহিনীরই অংশ, যারা একাত্তরের ২৫ মার্চ তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ধরে রাখতে লড়াই করেছিল একটি সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদার দেশ পাওয়া আর গড়ার জন্য। আজ ৫০ বছর পরও সেই দিনটির কথা মনে হলে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, চোখ সজল হয়।
পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগের কোনো বোধই কি আমাদের পুলিশ বাহিনীর নীতিনির্ধারক আর নির্দেশকদের স্পর্শ করে না? তাহলে তারা নিজের দেশের নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ, যঁারা তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন, তঁাদের সঙ্গে এমন আচরণ করে কীভাবে? নারীদের শরীরে অমানবিক আক্রমণ চালায় কীভাবে? শুধু তো তা–ই নয়, আন্দোলনকারীদের মানববন্ধনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এক থানা থেকে ওসির পরিচয়ে হুমকি পর্যন্ত দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না যে তাঁরা কোনো কর্মসূচি নিলে পুলিশ বলপ্রয়োগ করবে! একটা সভ্য সমাজে নাগরিকদের ওপর পুলিশের বলপ্রয়োগ এতই সোজা! এত ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তার হুমকি দেওয়া সাজে?
এখানেই শেষ নয়। আন্দোলনকারী যুবগোষ্ঠী, আগেই উল্লেখ করেছি, সময়ে–সময়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দাবি জানানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন আজ দেড় বছর ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা জানুয়ারির ২৫ তারিখ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে যান তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশায়। বাসভবনে ঢোকার আগে প্রথম চোটেই তাঁরা ধমক খান এতজন মিলে এসেছেন কেন। যাহোক, একপর্যায়ে তাঁদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বাসভবনের অপেক্ষাকক্ষে বসতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের সাক্ষাৎ তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি। বরং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েক গাড়ি পুলিশ এসে তাঁদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং তাঁদের ওপর নির্যাতন চালায়।
এ খবর আমাকে হতভম্ব করে দিয়েছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী একজন জনপ্রতিনিধি এবং সেই অর্থে নাগরিকদের অভিভাবক। একই সঙ্গে তিনি সরকারের প্রতিনিধি এবং এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক একজন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁর বাসভবনে তাঁর দর্শনাপেক্ষী কয়েকজন নাগরিক, যাঁরা নিশ্চয়ই তাঁর অনুমতি নিয়েই সেখানে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল—এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব? আমরা সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ, যে দেশে ক্ষমতাসীন আছেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দল তাঁরই কন্যার নেতৃত্বে, সেই দেশেই বাস করি তো? সে দেশে এমন অনৈতিক, অন্যায় আচরণ করতে পারে শাসকগোষ্ঠী? নিগৃহীতদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আক্ষেপ, ‘মাঠ থেকেও ধরে, ঘর থেকেও ধরে।’
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে বাণী আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশ পরিচালনার প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় ঘোষণা করা হচ্ছে—সবকিছু এত মূল্যহীন তাঁর অনুসারীদের কাছেই এবং তাঁদের পরিচালিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে? তাহলে এত প্রতিজ্ঞা, এত প্রত্যয়, এত আদেশ-নির্দেশ কার মানার জন্য? ‘আপনি আচরি পরেরে শিখাও’ আপ্তবাক্যটি একেবারেই কি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে তাঁদের কাছে? তাই যদি সত্য হয়, মানুষ কার ওপর আস্থা রাখবে?