কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন ১৯ বছর বয়সী এক পোশাকশ্রমিক। চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও সিঅ্যান্ডবি এলাকার পোশাক কারখানা থেকে অন্য সহকর্মীর সঙ্গে ফিরছিলেন তিনি। যাবেন আড়াই কিলোমিটার দূরে বহদ্দারহাট এলাকায়। রাত তখন ১০টা। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।
একে একে বাস থেকে সব যাত্রীকে নামানো হলেও শেষ যাত্রী ওই তরুণীকে নামানো হয়নি বহদ্দারহাটে। রাস্তায় তখন স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে অন্য গাড়ি। হঠাৎ চালক আনোয়ার হোসেন ওরফে টিপু চালকের আসন থেকে নেমে আসেন। সেখানে গিয়ে বসেন তাঁর সহকারী জনি দাস। আর গাড়িটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাহ আমানত সংযোগ সড়কের দিকে। একপর্যায়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন চালক। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তরুণী চালককে ঘুষি মেরে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে পড়ে যান। ১৯ মে নগরের বাকলিয়া রাহাত্তারপুল এলাকায় এ ঘটনা ঘটলেও তা সবার অজানা ছিল।
গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে আহত হন ওই তরুণী। ছিলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জ্ঞান ফেরার পর জানালেন বিস্তারিত পুলিশকে। পরে পুলিশ ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে ওই তরুণীর লাফ দেওয়ার সত্যতা পায়। গতকাল বুধবার রাতে হাটহাজারীর কুয়াইশ এলাকা থেকে সংশ্লিষ্ট গাড়িচালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ঘটনার শিকার তরুণী আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়িটি বহদ্দারহাট না থামিয়ে যখন বাকলিয়ার দিকে চালক নিয়ে যাচ্ছিল, থামাতে বললেও শোনেনি। উল্টো চালক এসে আমাকে গাড়ির পেছনের সিটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। এভাবে চালকের সঙ্গে ধস্তাধস্তি চলছিল।’
তরুণী আরও বলেন, ‘প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। পরে সাহস আসে মনে। সে (চালক) বারবার গাড়ির পেছনের সিটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি বাধা দিই। আমি হার মানতে রাজি নই। একপর্যায়ে গাড়িটি বাকলিয়া রাহাত্তারপুল এলাকায় এলে আশপাশে গাড়ি থাকায় কিছুটা কম গতিতে চলছিল বাসটি। এ সুযোগে বাস থেকে লাফ দিই। লাফ দেওয়ার আগে চালক ধরে রাখার চেষ্টা করে। তাকে বুকে, মুখে ঘুষি মারি।’
কীভাবে নিজের মধ্যে ওই সময় সাহস এসেছিল, প্রশ্নের জবাবে তরুণী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সিনেমায় দেখেছি। কেউ ধর্ষণের কবলে পড়লে নিজের চেষ্টায়, কখনো অন্যের সাহায্যে রক্ষা পায়। আমাকে যেহেতু বাসের ভেতর সাহায্য করার কেউ ছিল না, তাই নিজেকে নিজে সাহস করে এগিয়ে নিয়েছি।’
ভ্রাম্যমাণ চা-দোকানদার বাবার দুই মেয়ের মধ্যে বড় ওই তরুণী। তাঁর ছোট বোন পড়াশোনা করে। মা–ও তাঁর সঙ্গে একই কারখানায় চাকরি করেন।
মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাওয়ায় খুশি মা। আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে সাহস করে বাস থেকে লাফ দিয়ে ইজ্জত রক্ষা করেছে। আর কোনো মেয়েকে যাতে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়। দোষীদের শাস্তি যাতে হয়।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তরুণী সাহস করে চালককে ঘুষি মেরে লাফ দেন। চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চালকের সহকারী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চালককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। রোববার শুনানি হতে পারে। ঘটনায় ব্যবহৃত বাসটিও জব্দ করেছে পুলিশ।’
চলন্ত বাসে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অসহায় নারীদের বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া চট্টগ্রামের মানবাধিকারকর্মী তুতুল বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৈশাচিক এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি গাড়িতে চালক ও সহকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে।’
তুতুল বাহার আরও বলেন, ‘নারীরা রাস্তায় এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। হাজারো কর্মজীবী নারী রাতে বাসায় ফেরেন। রাস্তায়, যানবাহনে তাঁরা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, সে পরিবেশ সৃষ্টিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে।’