খুব খারাপ সময় পার করছেন? তাহলে লেখাটি আপনার জন্যই।
হয়তো এই মুহূর্তে আপনি জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ সময় পার করছেন। দিনের কোনো না কোনো সময়ে হয়তো ভিজে যাচ্ছে দু’চোখ, বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আকাশ পানে। দেখতে পেলেন আপনারই মত একটি নিঃসঙ্গ চিল চক্রাকারে ঘুরছে। আপনি সাবকনশাসলি নিজেকে প্রশ্ন করলেন; আচ্ছা, ঐ চিলটারও কি কোনো দুঃখ আছে? আমার মতো সেও কি খুব কঠিন সময় পার করছে?
হ্যাঁ অথবা না উত্তর তো যাই আসুক, আপনাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই চিরসত্য একটি বাস্তবতা। আর তা হলো, শুধু আপনিই নন। এই জগৎ-সংসারে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা আপনার থেকেও অনেক অনেক গুণ বেশি কষ্টে আছে। আমরা হয়তো বাহ্যিকভাবে মুখের হাসি আর চঞ্চলতাটাই দেখি। একটা মানুষ নিজের সাথে কীভাবে যে লড়ে যাচ্ছে সেই উপাখ্যান আমাদের অনেকেরই জানা থাকে না।
প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোন, আমরা মুমিন আলহামদুলিল্লাহ। “মুমিন আর বিপদ” এই দুটো শব্দের যেন আজন্ম মিতালি। আপনি মুমিন কিন্তু আপনার জীবনে বিপদ আসবে না, এটা অস্বাভাবিক। আপনার ইমানের শক্তি যত বেশি, আপনার বিপদও ততই কঠিন।
আপনি একজন শক্তিশালী ইমানদার ব্যক্তি, তাহলে আপনার জীবনে এত বিপদ আসছে কেন? আপনি ত আল্লাহর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। নামাজ আপনার সঙ্গী, কুরআন আপনার চক্ষু শীতলকারী, জিকির আপনার অন্তর প্রশান্তকারী। তবুও কেন এত বিপদ? মনে হতে পারে, তবে কি আল্লাহ আমাকে ভালোবাসছেন না? আল্লাহ কি আমার উপর গজব নাযিল করছেন?
না! আমার ভাই ও বোন, এমনটা নাও হতে পারে। আপনি হতাশ হবেন না প্লিজ। আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখুন। আল্লাহ কী বলেছেন আপনার মনে নেই? সূরা বাকারার ১৫৫ থেকে ১৫৬ নং আয়াতটি খুলে দেখুন।
আল্লাহ বলেছেন-
وَ لَنَبۡلُوَنَّکُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿۱۵۵﴾ۙ
الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَصَابَتۡہُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّا لِلّٰہِ وَ اِنَّاۤ اِلَیۡہِ رٰجِعُوۡنَ ﴿۱۵۶﴾ؕ
অর্থঃ
“আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি এবং ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে! তবে সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা ধৈর্যশীল এবং বিপদের সময় বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আমাদের সবাইকে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”
হ্যাঁ, আমার ভাই ও বোন। দুনিয়ার অবস্থানরত প্রত্যেক মাখলুক, হোক সে মুসলিম অথবা অমুসলিম আল্লাহ সকলকেই পরীক্ষা করবেন। তবে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাই সেইসব মুমিনদের সুসংবাদ দিতে বলেছেন যারা ধৈর্যশীল এবং যারা বিপদেও নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমার জীবনটাই তো আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ এবং একদিন তাঁর কাছেই আমাকে ফিরে যেতে হবে।
এ বিষয়ে একটি চমৎকার হাদীসও আছে। আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমি তা উল্লেখ করছি ইন শা আল্লহ।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“মুমিনের বিষয়াদি কত আশ্চর্যের! তার সবকিছুই কল্যাণকর। আর এটা তো কেবল মুমিনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সচ্ছলতায় সে শুকরিয়া আদায় করে, তখন তা তার জন্যে কল্যাণকর হয়। আর যদি তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে তাহলে সে সবর করে, ফলে তাও তার জন্যে কল্যাণকর হয়ে যায়।” -(সহীহ মুসলিমঃ ২৯৯৯)
আর উপরের সেই প্রশ্নগুলোর মত আপনার মনেও যদি এমন কিছু ঘুরপাক খায়, তবে এই ঘটনাটি পড়ুন।
আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) বলেন,
আমি নবী (সা.)-এর কাছে গেলাম, তখন তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তাঁর ওপর আমার হাত রাখলে তাঁর গায়ের চাদরের ওপর থেকেই তাঁর দেহের প্রচণ্ড তাপ অনুভব করলাম।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কত তীব্র জ্বর আপনার।
তিনি বলেন, আমাদের (নবী-রাসুলগণের) অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। আমাদের ওপর দ্বিগুণ বিপদ আসে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারও দেওয়া হয়।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কার ওপর সর্বাধিক কঠিন বিপদ আসে?
তিনি বলেন, নবীগণের ওপর।
আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তারপর কার ওপর?
তিনি বলেন, তারপর নেককার বান্দাদের ওপর। তাদের কেউ এতটা দারিদ্র্যপীড়িত হয় যে শেষ পর্যন্ত তার কাছে তার পরিধানের কম্বলটি ছাড়া কিছুই থাকে না। তাদের কেউ বিপদে এত শান্ত ও উৎফুল্ল থাকে, যেমন—তোমাদের কেউ ধন-সম্পদপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে।
-(ইবনে মাজাহঃ ৪০২৪)
এবং আরো একটি হাদীস হলো-
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন,
“মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।”
-(বুখারি: ৫৬৪২)
সুবহানাল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহু আকবার! নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনার অন্তর কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে, তাই না?
আপনার অন্তর পুরোপুরি শান্ত করার জন্য আরো কিছু হাদীস উল্লেখ করছি।
রাসুল (স.) বলেন, “মুমিনের জন্য দুনিয়া কারাগারসদৃশ ও কাফিরের জন্য জান্নাতসদৃশ।”
-(মুসলিম: ২৯৫৬)
রাসুল (স.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর কোনো বান্দার মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করেন, তখন দুনিয়ায় তাকে তাড়াতাড়ি বিপদাপদের সম্মুখীন করেন।
আর যখন তিনি কোনো বান্দার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন, তখন তার গুনাহের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন।
অবশেষে কেয়ামতের দিন তাকে এর পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করেন। আর আল্লাহ তাআলা যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেন।
যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি থাকে, আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি থাকে’।
-(তিরমিজি: ২৩৯৬; মেশকাত: ১৫৬৫)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো ব্যক্তির জন্য বিনাশ্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদার আসন নির্ধারিত হলে আল্লাহ তার শরীর, সম্পদ অথবা সন্তানকে বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর সে তাতে ধৈর্যধারণ করলে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত উক্ত মর্যাদার স্তরে উপনীত হয়।
-(আবু দাউদ: ৩০৯০)
কী? এতক্ষণে বুঝতে পারলেন তো, বিপদে আছেন তার মানে এই না যে, আপনি আল্লাহর অপ্রিয় বান্দা বা আপনার ওপর আল্লাহর গজব এসেছে। বরং আল্লাহ আপনার মর্যাদা উন্নীত করার জন্য আপনাকে সামান্য বিপদে ফেলছেন। কারণ জান্নাত আসলে এমন একটি স্থান, যেখানে আমরা শুধু আমলের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারব না। তাই আমাদের রব আমাদের সাময়িক কিছু পরীক্ষা নেন, যাতে আমরা সেই পরীক্ষায় সবরের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে জান্নাতে যাওয়ার মত মর্যাদা অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমীন।
বিপদ বা কঠিন পরিস্থিতিতে যেসব দুআ পড়তে পারেন-
১।
إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ، اَللَّهُمَّ أْجُرْنِيْ فِي مُصِيْبَتِيْ وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِّنْهَا
আমরা আল্লাহ্র জন্য, আর আমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ্! আমার মুসিবতের জন্য আমাকে প্রতিদান দাও! এবং এর চেয়ে উত্তম কিছু আমাকে দাও!
বিঃদ্রঃ উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) কে বলতে শুনেছিঃ কোন মুসলিমের ওপর মুসীবত আসলে যদি সে বলেঃ (উপরে দোয়াটি উল্লেখিত হয়েছে) তবে মহান আল্লাহ্ তাকে এর চেয়ে উত্তম বস্তু দান করে থাকেন।
-(মুসলিমঃ ৯১৮)
২।
اَللّٰهُمَّ لَا سَهْلَ إِلَّا مَا جَعَلْتَهُ سَهْلاً، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحَزْنَ إِذَا شِئْتَ سَهْلاً
হে আল্লাহ! আপনি যা সহজ করেছেন তা ছাড়া কোনো কিছুই সহজ নয়। আর যখন আপনি ইচ্ছা করেন তখন কঠিনকেও সহজ করে দেন।
-(সহীহ ইবন হিব্বান ২৪২৭)
৩।
اَنِّىۡ مَسَّنِىَ الضُّرُّ وَاَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِيۡنَ
আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি। আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।
(সূরা আল আম্বিয়া – ২১:৮৩)
বিঃদ্রঃ দুঃখ-কষ্ট, রোগ-যন্ত্রনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দরবারে হযরত আইয়ুব (আ.)-এই দুআ করেছিলেন।
৪।
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।
বিঃদ্রঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দো‘আটি বেশি বেশি করতেন।
-(বুখারীঃ ৭/১৫৮)
৫।
اَللّٰهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُوْ، فَلَا تَكِلْنِيْ إِلٰى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ، وَأَصْلِحْ لِيْ شَأْنِيْ كُلَّهُ، لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ
হে আল্লাহ! আমি আপনার রহমতেরই আশা করি। তাই আপনি এক নিমেষের জন্যও আমাকে আমার নিজের কাছে সোপর্দ করবেন না। আপনি আমার সার্বিক বিষয়াদি সংশোধন করে দিন। আপনি ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই।
-(আবূ দাউদ, ৪/৩২৪)
লেখাঃ মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া