বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্যতম স্থান হলো ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই জায়গার সাথে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ভাষণ দিয়েছিলেন এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই। আবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের সাক্ষী হল এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একসময় ছিল প্রাণদায়ী বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ এক সবুজে ঘেরা নিকুঞ্জ। পাখ পাখালির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত থাকতো এই জায়গা। যান্ত্রিক ঢাকা শহরের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ থেকে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্য মানুষ এই উদ্যানেই আসে সময় কাটাতে। কংক্রিটের এই ঢাকা শহরে এই উদ্যান যেন মরুভূমির বুকে বিরল জলাশয় খুজে পাওয়ার উদাহরণ। তাই এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বলা হয় ঢাকা শহরের ফুসফুস।
কিন্তু বর্তমানে এই জায়গার গাছপালা কমতেই আছে। ইতোমধ্যে উদ্যাদের অর্ধশতাধিক গাছ কাটা হয়ে গেছে এবং সেখানে তৈরি করা হবে রেষ্টুরেন্ট। এরকম গাছ হত্যা পরিকল্পনাই চলছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই এই কাজের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । তবে কি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই সবুজের সমারহ কতটা জরুরি তা আমরা আসলেই ভুলে যাচ্ছি ? ঢাকা শহরের আবহাওয়া এমনিতেই অনেক বেশি গরম এবং বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন এর পরিমাণ বেশি। গাছপালার পরিমান কমে যাওয়ার ফলে ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরছে দিনকে দিন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও সরকারি গণপূর্ত বিভাগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৭টি রেষ্টুরেন্ট স্থাপন করার কাজ শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই এই কাজ করছে বলে তাদের দাবি। উন্নয়ন মূলক কাজের নামে এই গাছ নিধন ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে সাধারণ জনগণের মনে। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন ভুলে যাচ্ছে এভাবে গাছ কেটে ফেল্লে তা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে?
সাধারণ জনগণের দাবি গাছ না কেটেও উন্নয়নশীল কাজ করা যায়। আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উদ্যানের পরিবেশ যেমন সবুজ রাখা সম্ভব তেমনি উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করাও সম্ভব। কিন্তু এক তরফা এভাবে গাছ কেটে যাওয়া, আর বিনিময়ে শুধু দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে স্থাপনা তৈরি করা একসময় পুরো ঢাকা নগরীর জন্যই পরিবেশগত এক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আমরা সবাই এই কথার অবগত যে, প্রকৃতি কখনো ছাড় দেয় না।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িত স্বাধীনতা স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভের পাশে রয়েছে জলাশয়। গাছগাছালি আর জলাশয় মিলিয়ে একটি ভারসাম্যযোগ্য ইকো সিস্টেম এখানে বিদ্যমান থাকবে যদি অবিচারে এভাবে বৃক্ষ নিধন না করা হয়। খাবার রেষ্টুরেন্ট নির্মাণ অথবা অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের নামে ইতিহাসের সাক্ষী এই মুল্যবান এই সবুজ সম্পদ ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া চলছে তার চরম মূল্য অচিরেই আমাদের দিতে হবে। তবে কি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ নয়, কংক্রিটের জঙ্গল দেখার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি?? এটাই কি এই উদ্যানের পরিণতি??