কুরবানি দেওয়া এক পবিত্র ইবাদত। যা করতে উৎসাহিত করেছেন মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। প্রতি বছর পবিত্র জিলহজ মাসে সারা বিশ্বের মুসলিমরা ছাগল, ভেড়া, গরু অথবা উট কুরবানি করে। এটি মূলত নবি ইবরাহিম আলায়হিস সালামের তার পুত্রকে আল্লাহর আদেশে কুরবানি করার ইচ্ছার প্রতিফলনস্বরূপ। কুরবানির অনেক নিয়ম রয়েছে যা অবশ্যই পশু জবাইয়ের সময় খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় সেটা কুরবানি হিসেবে গণ্য হবে না।
কুরবানির নিয়মগুলো কি কি?
কুরবানি কারা দেবে? কখন আমরা কুরবানি দেব? কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বিষয় কি বিবেচনায় নিতে হবে?
ভাববেন না একটুও! আমরা এই লেখায় কুরবানি নিয়ে আপনার যা যা জানা দরকার সবই একত্রিত করেছি।
কাদের অবশ্যই কুরবানি দিতে হবে?
অধিকাংশ উলামাদের মতে, কুরবানি দেওয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। হানাফি মাজহাব অনুসারে, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমদের প্রয়োজনের চেয়ে অধিক পরিমাণ সম্পদ রয়েছে অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাদের জন্য কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব।
সাধারণত যারা জাকাত দিতে সক্ষম তারা কুরবানিও দিতে পারবে।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে।’ – মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৩৫১৯; আত তারগিব ওয়াত তারহিব ২/১৫৫
হানাফি মাজহাবে এসেছে যে কুরবানি তাদের ওপর ফরজ যাদেরঃ
প্রতিটা প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর।
ভ্রমণরত নয় এমন ব্যক্তির ওপর।
যাদের এমন সম্পদ আছে যা তাদের প্রয়োজনের চাইতেও বেশি। অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের সমান বা তার চেয়ে বেশি। নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
রবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।
কোন বয়সে কুরবানি ফরজ?
কুরবানি ফরজ কি ফরজ না এ বিষয়ে মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে যারা প্রাপ্তবয়স্ক এবং যাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে তাদের জন্য কুরবানি ওয়াজিব করা হয়েছে। এতে তারা বিপুল সাওয়াব পাবেন।
কখন কুরবানির পশু কিনতে হবে?
কুরবানির পশু ইদের বেশ আগে কেনাই উত্তম। সকল কুরবানি ১০-১২ জিলহজের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
কুরবানির সময় শেষ হয়ে যায় যখন চতুর্থ দিনের সূর্য ডুবে যায়। তাই ১৩ জিলহজের মাগরিবের সালাতের আগেই কুরবানির পশু অবশ্য অবশ্যই কিনে ফেলুন এবং সেটার দাম পরিশোধ করুন। তবে কুরবানি যত দ্রুত দেওয়া সম্ভব ততই ভালো হবে। কুরবানির পশু ইদের বেশ আগে কিনলে পশুর সাথে একটা আবেগের সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, তার প্রতি মহব্বত গড়ে ওঠে। এতে ত্যাগের অনুভূতি কিছুটা বা অনেকটাই পাওয়া যায়, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ইদের আগের রাতে পশু কিনলে পরদিন সকালে কুরবানি করলে পশুর সাথে বন্ধন গড়ে ওঠে না।
কুরবানি কখন করতে হবে?
কুরবানি কি তিন দিন না চার দিনে করতে হবে এই বিষয়ে উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে তিন দিনের মধ্যে করে ফেলাই সর্বোত্তম।
কখন কুরবানির গোশত বিতরণ করতে হবে?
কারো সাথে শরিকে কুরবানি করলে ওজন করে কুরবানি বিতরণ করতে হবে। কেবল অনুমান করে ভাগ করা যাবে না। সুতরাং, কুরবানির গোশত ৭ জনের শরিকে কুরবানি দেওয়া হলে সাতজনকে মেপে মেপে কুরবানির গোশত দিতে হবে।
কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির গোশত একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরীব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ গরিব-মিসকিনদের দিতেন।
এ ছাড়া ইবন মাসউদ (রা.) কুরবানীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজেরা খেতেন, একভাগ যাকে চাইতেন তাকে খাওয়াতেন এবং একভাগ ফকির-মিসকিনকে দিতেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
কুরবানির মাংস আত্মীয় ও গরিবদের মাঝে বিতরণ না করাটা খুবই গর্হিত কাজ। এতে কৃপণতা প্রকাশ পায়। কারণ কুরবানির মাধ্যমে কুরবানিদাতা অহংকার থেকে নিরাপদ থাকেন এবং তার অন্তর পরিশুদ্ধ থাকে। পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম।
জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।
কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে?
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়িজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়িজ নয়।
কুরবানির পশুর বয়সসীমা কত হবে?
গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়িজ। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।
উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়িজ হবে না।
কুরবানীর পশু জবাই করার পদ্ধতি
কুরবানির পশু জবাইয়ে আমাদেরকে মানবিকতা ও ইহসানের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবেঃ
• কোরবানি করার জন্য একটি ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে – ভোঁতা ছুরি অপ্রয়োজনীয় ব্যথা এবং কষ্টের কারণ হতে পারে।
• কোরবানির পশুর সামনে ছুরি ধারালো করা যাবে না।
• অন্য পশুর সামনে কোনো পশু জবাই করা যাবে না।
• কোরবানি করার সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলতে হবে।
• পশুর শরীর সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত পশুর চামড়া তোলা যাবে না।